উত্তরাধিকার
– আমির হোসেন
সবুজের ঢেউয়ের মতো ছোট ছোট পাহাড় ও টিলাময় এ অঞ্চলটিতে যখন রহম আলীর দাদার দাদা বসতি স্থাপন করেছিল তখন নাকি লোক বসতি প্রায় ছিল না বললেই চলে। সে সব তো রহম আলীর নিজ চোখে প্রত্যক্ষ করার কথা নয়। তার দাদার দাদা যখন আগাছা ও জঙ্গল কেটে সাফ করে ভিটেবাড়ি তৈরি করে, চিটেগুড়ের মতো লাল মাটিতে খুন্তি-শাবল চালিয়ে কেটে কেটে সেই ভিটেতে মাটির দেয়াল তৈরির জন্য বুনি করে, তখন হয়ত তার দাদা হামাগুড়ি দিয়ে দিয়ে আশপাশের আড়া-জঙ্গল ও হাবারের দিকে ছুটে যেত। কখনো ভিটে থেকে অদুরে বিশালাকৃতির চামকাঁঠাল গাছের নিচে সুউচ্চ ডাল থেকে বুটা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে ছড়িয়ে থাকা পাকা চামকাঁঠালের টক-স্বাদযুক্ত কোষ মুখে পুড়ে দিয়ে বীচিসহ গিলে ফেলেছে। আবার কখনো বা তেলতেলে লালচে পাখনা, ধানকাটার আলওয়ালা কাস্তের মতো বাঁকানো লেজ ও মাথায় মাংসল-লাল জুটিওয়ালা বনমোরগের পিছু নিয়েছে। লাফিয়ে চলা ধূসর-সাদা খরগোসকেও অনুসরণ করেছে কখনো কখনো। কিংবা বড় বড় বরাক বা মাহাল বাঁশের ঝাড়ের নিচে ফনাতোলা পানুকের মাথায় না বুঝে খেলাচ্ছলে নির্দিষ্ট সময় বিরতিতে পর পর থাপ্পর দিয়ে চলেছে সেকথা কে বলবে। সেসব কথা তো রহম আলী অরণ্য-প্রকৃতির বৈচিত্রার নিরিখে তার অভিজ্ঞতা দিয়েই অনুমান করে নিয়েছে। তবে সে তার দাদার কাছে শুনেছে এলাকাটি নাকি তখন ছিল পাহাড়-টিলা আর ফাঁকে ফাঁকে লুঙ্গা-ছড়ার সমন্বয়ে ঢেউ হেলানো অরণ্যময় ও জঙ্গলাকীর্ণ দুর্গম অঞ্চল। ত্রিপুরার পর্বত ও পাহাড় শ্রেণির সাথে সংযোগ থাকায় এ অঞ্চলটিতে হিং¯্র বাঘ, ভাল্লুক ও অন্যান্য বন্যপ্রাণির আক্রমণ আশঙ্কা ছিল বেশি। তাছাড়া বিষাক্ত পোকামাকড়ের কামড়ে এবং ম্যালেরিয়া জ¦রের প্রকোপ হেতু মারা যেত প্রচুর মানুষ। তথাপি কামরূপ, আসাম ও ব্রহ্মদেশ থেকে খাদ্যের সন্ধানে বিভিন্ন ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে ভীল, সাঁওতাল, নাগা, কুকি, মু-া, কোচ ইত্যাদি আদিম মানুষেরা ত্রিপুরা রাজ্যের অরণ্যঘেরা এ অঞ্চলটিতে এসে কিছু কিছু বসতি স্থাপন করেছিল। কারণ এখানে আম, কাঁঠাল, লিচু, আনারসসহ বিভিন্ন ধরনের ফল ও বন্যপ্রাণির মাংস পাওয়া যেত। দোয়েল, ময়না, টিয়া, ঘুঘু, বক, নিশিবক, শামুককচ্চা, হলদে পাখি, বনমোরগসহ প্রচুর পাখির জন্য অভয়ারণ্য ছিল অঞ্চলটি। যদিও এসব আদিবাসিরা পশু ও প্রাণির মংস এবং ফল-মূলের সন্ধানে ঘন ঘন স্থান পরিবর্তন করত। তবে সিলেট থেকে কমিল্লার লালমায় পর্যন্ত উত্তর-দক্ষিণের টারশিয়ারি পাহাড়ের অন্তর্গত টেকটোনিক প্লেটের উপর দাঁড়ানো পাহাড়-অরণ্যঘেরা সেজামুড়া, লত্তামুড়া, বক্তারমুড়া, চন্ডিমুড়া ইত্যাদি অঞ্চল থেকে চার-পাঁচ মাইল পশ্চিমে আওলিয়াজুড়ি নামের ছোট্ট নদীটির তীরে তখন বসতি গড়ে উঠেছিল। আওলিয়াজুড়ি মানে দরবেশের নদী। এ নামের সঙ্গে এখানে মুসলিম আওলিয়া-দরবেশেদের আগমন ও ইসলাম প্রচারের ঘটনাও জড়িত ছিল। চম্পকনগর, দাসপাড়া, পেটোয়াজুরি, ইছাপুর, টুকচানপুর ইত্যাদি অঞ্চলে কৃষি ও মৎস নির্ভর মানুষের বসতি ছিল। হিন্দু, মুসলিম ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের লোকেরা বসবাস করত এ পাহাড়-অরণ্যের পাদদেশ ও নদী উপত্যকাময় উর্বর ভূমিতে। যদিও মুসলিম শাসকদের প্রভাবে এক সময় বৌদ্ধদের বিলুপ্তি ঘটেছিল। তথাপি হিন্দু ও মুসলমানেরা সম্প্রতির বন্ধনে আবদ্ধ থেকে পাশাপাশি বসবাস করে আসছিল। সে সময় মোঘল রাজ্যত্বকালে পার্বত্য ত্রিপুরার রাজধানী উদয়পুর আক্রান্ত হয়েছিল মোঘল সেনাপতি দাউদ খাঁর নেতৃত্বে। সেনাপতি দাউদ খাঁ এখানকার সমৃদ্ধ প্রকৃতিক সৌন্দর্যে বিমোহিত হয়ে যুদ্ধ শেষে দেশে ফিরে যান নি। তিনিও চম্পকনগরের উত্তরে বসতি স্থাপন করেছিলেন। তাঁর নামানুসারেই করা হয় দাউদপুর পরগনার নামকরণ। তখন এতদঞ্চলে তিব্বতসহ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল দিয়ে ইয়েমেন ও অন্যান্য আরব দেশ হতে ইসলাম প্রচারের জন্য এদেশে অনেক সুফি-সাধক ও পীর-দরবেশের আগমন ঘটেছিল। সেজামুাড়া অরণ্যাঞ্চলের অদুরে বাঘা ফকির নামের একজন দরবেশ এসে বসতি করেছিলেন। রহম আলীর দাদার দাদা ছিলেন সেই ফকির-দরবেশের ভক্ত আছহাব বা সাথী। সেই সন্ন্যাসী-ফকির সেখানকার পাহাড়-টিলাময় অরণ্যাঞ্চল থেকে দুর্গমপথ পায়ে হেঁটে এসে আওলিয়াজুড়ি নদীর তীরবর্তী বিভিন্ন অঞ্চলে ভিক্ষে করে ফিরতেন। তবে কখনো কখনো নাকি বাঘের পিঠে সওয়ার হয়ে রাত-বিরাতে তাকে ঘোরাঘুরি করতে দেখেছে কেউ কেউ। সেই কারণেই হয়ত তার নাম প্রথমে বাঘা ফকির এবং পরবর্তীতে বাঘা পীর বলে চাউর হয়েছিল আশপাশের গ্রামগুলিতে। আওলিয়াজুড়ির তীরবর্তী মানুষের কাছে ঐ বাঘা ফকিরের বহু কেরামতি তখন কিংবদন্তি হয়ে গিয়েছিল। গ্রামে গ্রামে ভিক্ষে করতে গিয়ে দাসপাড়া গ্রামের ফুলমন নেছা নামের এক সুন্দরী রমনীকে তার পছন্দ হয়। তিনি তাকে বার বার বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েও ব্যর্থ হন। ঘটকের উপর বিরক্ত হয়ে ফুলমন একদিন বললেন, তোমার ঐ বাঘা ফকির আমাকে বিয়ে করতে হলে তাকে একটি শর্ত পালন করতে হবে। পারবেন তিনি সে শর্ত পালন করতে? ঘটক ফিরে এসে ফকিরকে সে কথা জানালে, ফকির জানতে চায়লেন কি সেই শর্ত? ঘটক বলল, আপনি ফুলমনকে বিয়ে করতে হলে বিয়ের বরযাত্রী হিসেবে একশত বাঘ নিয়ে গিয়ে সেখানে উপস্থিত হতে হবে। সন্ন্যাসী-ফকির শর্তে রাজি হয়ে গেলেন। এবং নির্ধারিত দিনে একশত বাঘবরযাত্রী নিয়ে গিয়ে তিনি হাজির হলেন এবং ফুলমনকে বললেন, তাঁর সাথী-বরযাত্রী বাঘদের খাবারের ব্যবস্থা করতে। ফুলমন তাদের গোয়াল থেকে বড় দুটি বলদ গরু বের করে দিলে সকল বাঘ মিলে গরু দুটিকে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করল। একটি বাঘ বাদে অন্যান্য বাঘগুলি খাদ্যগ্রহণ শেষে সন্তুষ্টচিত্তে বিদায় নিল। অবশিষ্ট বাঘটি ফকিরের ছায়া হয়ে রইল। সম্ভবত এ বাঘটিতেই ফকির সওয়ার হতেন। ফুলমনের সাথে দীর্ঘ দাম্পত্য জীবন শেষে বাঘা ফকির যেদিন মৃত্যুবরণ করেন সেদিন নাকি প্রভুভক্ত সেই বাঘটিও মৃত্যুবরণ করেছিল। বাঘটি মৃত্যুবরণ করে যেখানে পড়েছিল সেখানেই বাঘা ফকিরের মাজার স্থাপিত হল। এবং ঐ ফকিরের নামানুসারে সে স্থানের নামকরণ করা হল ফকিরপাড়া। সেই কিংবদন্তি পীরের আছহাব ছিলেন রহম আলীর দাদার দাদা। সম্ভবত ঐ পীরের প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধার বসবর্তী হয়েই তিনি সেজামুড়ার অরণ্যাঞ্চলে বসতি স্থাপন করেছিলেন। আজ চার শতাধিক বছর পরে এসেও তার সেই সন্ন্যাস-পীরভক্ত পৈতৃক পুরুষের বসতির আঁঠালো লাল মাটিকে আকড়ে ধরে আছে রহম আলী। তবে বড় নিদারুন জীবন-যাবন করতে হচ্ছে তাকে। রহম আলীর পূর্ব-পুরুষের বংশকুল তেমন বৃদ্ধি পায় নি। তাদের কেউ কেউ হিং¯্র প্রাণির আক্রমণে অকালে মৃত্যুবরণ করছে। কেউ কেউ ম্যালেরিয়াসহ বিভিন্ন রোগ-শোকের প্রকোপে কপোকাত হয়েছে। আবার কেউ কেউ ছিল বন্ধা-নিঃসন্তান। বসতিও স্থানান্তরিত করেছে অনেকে। সে জন্য চার-পাঁচ পুরুষের কান্ডারী হিসেবে সেজামুড়ার লাল মাটির ঘরের বসতিকে আকড়ে ধরে এখনও নিভু নিভু প্রদীপ শিখার মতো মরতে মরতে বেঁচে আছে একমাত্র রহম আলী। কিন্তু তার মৃত্যুর পর এ বংশে আর কোন উত্তরাধিকার থাকছে না নিঃসন্তান রহম আলীর।
সেই দেশভাগের আগের কথা। স্ত্রী রহিমা বেগম ও একমাত্র পুত্র রহম আলীকে নিয়ে ছোট সংসার ছিল রহম আলীর পিতা করম আলীর। লোঙ্গা-ছড়ায় মৌসুমী কৃষিকাজ, বনের বিভিন্ন ফল-ফলারি, কৃষি ও মৎস শিকারে ব্যবহৃত বাঁশ-বেতের তৈরি বিভিন্ন পণ্য, গরু-ছাগলসহ অন্যান্য পোষা প্রাণি পালনের উপর নির্ভর সেজামুড়া, বহতারমুড়া, লত্তামুড়া ও চ-িমুড়ার অদিবাসিগণ ততদিনে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেছিল। করম আলীর সংসারও চলছিল এক রকম ঘানি টানা কুলুর মতো। লোঙ্গা-ছাড়ায় সামান্য ধানি জমি, একটি দুধের গাইসহ দু-তিনটি গৃহপালিত পশু তো ছিলই, এছাড়া রহিমা বেগম সারা বছরই কিছু হাঁস-মুরগি পালন করত। সেই সাথে বাঁশ ও বেত দিয়ে কৃষিকাজের জন্য হাঁড়ি, কুলা, টুকরি, চালুন, ঢোল-জাবার এবং মৎস শিকারের জন্য খলই, চাঁই, আনতা, ভিওর, পলো, ডোলা ইত্যাদি পণ্য তৈরিতে স্বামী করম আলীকে সহযোগিতা করত। মৌসুমী ও প্রান্তিক এ কৃষিকাজে বছরের মাত্র এক-দুই মাস ব্যস্ত থাকতে হত। আর বাদবাকি সময় হাতে তৈরি ঐ সব পণ্য ভার বহনের মাধ্যমে কাঁধে করে মাইলের পর মাইল দুর্গম-বন্ধুর পথ পাড় হয়ে দূরের কোন হাটে বিক্রি করতে যেত করম আলী। মাঝে মাঝে সবচেয়ে কাছের মাত্র ছয়-সাত মাইল দূরের বাজার চম্পকনগরে নিয়ে গিয়েও বিক্রি করত তার সামগ্রিক পণ্য সম্ভার। সে সময় বেহুলা-লক্ষিন্দরের কাহিনী শুনেছিল করম আলী। সে কাহিনী শিশু পুত্র রহম আলীর কাছে গল্প করে বলেছিল সে। সাপের দেবী মনসাকে পুজা করতে নাকি অস্বীকৃতি জানিয়েছিল চাঁদ-সওদাগর। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে একে একে তার ছয়-পুত্রকে বাসর রাতে কেটে ধ্বংস করেছিল সর্পদেবী মনসা। সপ্তম পুত্র লক্ষিন্দরকে যাতে দংশন করতে না পারে সেজন্য বগুড়ার মহাস্থানগড়ে লোহার বাসরঘর বানিয়েছিল সওদাগর। কিন্তু কারিগরকে স্বপ্নে ভয় দেখিয়েছিল মনসা। লোহার বাসরঘরে যদি ছোট কোন ছিদ্রপথ না রাখা হয় তাহলে তাকে করবে নির্বংশ। কারিগর ঐ বাসরঘরে সামান্য ছিদ্র রেখে মোম দিয়ে সেই ছিদ্রপথ বন্ধ করে দিয়েছিল। বেহুলা-লক্ষিন্দর সেই লোহার বাসরে প্রবেশ করলে মনসা পাঠাল সুতানালী সাপকে। সুতানালীর তীক্ষè জিহবা নিসৃত তাপে গলে গেল মোম। আর ছিদ্রপথ দিয়ে সন্তর্পনে প্রবেশ করল লোহার বাসর ঘরে। মনসার মানস বাসনা পূরণার্থে কাটল সওদাগরের সর্বশেষ পুত্র লক্ষিন্দরকে। মনসার সন্ধানে সাপে কাটা স্বামী লক্ষিন্দরকে নিয়ে ভেলায় করে অজানা পথে কালিদহ সায়রে ভাসল বেহুলা। ভাসতে ভাসতে নাকি সেই ভেলা আওলিয়াজুড়ি নদী দিয়ে চম্পকনগর ঘাটে এসে ভিরেছিল। এবং একরাত্রী সেখানে অবস্থান করেছিল। সেই বেহুলা-লক্ষিন্দরের স্মৃতি-বিজড়িত চম্পকনগর বাজারে সপ্তাহিক হাটে বাঁশজাত পণ্য ও বাঁশ কাঁধে করে নিয়ে বিক্রি করে সংসারের প্রয়োজনীয় ব্যায় মিটাত দরিদ্র করম আলী। বেহুলা-লক্ষিন্দরের কাহিনী শোনার পরই রহম আলীও তার বাবার সাথে হাটের দিন চম্পকনগর বাজারে যাওয়ার জন্য বায়না ধরে। একদিন নিয়েও গিয়েছিল ওকে করম আলী। সেই থেকে শুরু। আজ সত্তরোর্ধ বয়সেও কাঁধে করে বাঁশ বহন করে দূর-দূরান্তের বিভিন্ন বাজারে বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করে আসছে রহম আলী।
রহম আলীর একমাত্র মেয়ে সখিনাকে নিজের পেটে ধারণ করে নি তার স্ত্রী সাজেদা বেগম। দাম্পত্য জীবনের দেড় যুগ ধরে একটিমাত্র সন্তানের আসায় সকাল-সন্ধ্যায় মাথা কুটেছে সাজেদা বাঘা পীরের মাজারে। বাজুবান্দ হিসেবে কুনুইর উপর বাহুতে ধারন করেছে খাদেমের কাছ থেকে নির্ধারিত শিন্নি দিয়ে আনা কবজ ও কাইতনপড়া। খেয়েছে খাদেমের দেয়া পানিপড়া ও তেলপড়া। রহম আলীর দাদার দাদা এ পীরের আছহাব ছিল এ বিষয়ে কিঞ্চিত অহংবোধ ও বিশ^াস-আস্থাতে পরিপূর্ণ মন নিয়ে প্রতি বৃহস্পতিবার এলে নিয়মিত মাজারে ধরিয়েছে আগরবাতি-মোমবাতি। তারপরও সাজেদার কোল জুড়ে আসেনি ফুটফুটে একটি শিশু সন্তান। সবশেষে রহম আলী ও সাজেদা বেগম দত্তক এনেছিল শিশু সখিনাকে। শিশুটিকে কোলে পেয়ে মাতৃত্বের দীর্ঘ তৃষ্ণায় বুকের হাহাকার জুড়িয়েছিল সাজেদা বেগম। কোলে-পিঠে করে পরম যত্নসহকারে বড় করে তুলেছে তাকে। শৈশব পেড়িয়ে কৈশোর আসতে না আসতেই শৈল সমারোহে সুষমামন্ডিত অরণ্যাঞ্চলের একটা রূপময় আবেশ যেন ছড়িয়ে পরেছিল সখিনার সর্বাঙ্গজুড়েও। দরিদ্র পিতা রহম আলীর লাল মাটির দেয়াল বেষ্টিত আঁধার ঘরে আলোর নিখুত সন্নিবেশ ঘটিয়েছিল সখিনা। কিন্তু এ আলোর সহজাত উদ্ভাস সহজে সয়বে কেন সেজামুড়ার গিদরগুলি। অরণ্যঘেরা টিলা আর লোঙ্গা-ছড়ার বুক জুড়ে সন্ধ্যা নামার সাথে সাথেই যেমন শিকারের জন্য পগাড়ের ওপার থেকে হুক্কা দিয়ে এগিয়ে আসে শিয়ালের ঝাঁক এবং ঘুউত ঘুউত শব্দ করে আড়া-জঙ্গল হতে বের হয় বন্য শকুরের দল। তেমন করেই সময়-সুযোগে বনপথের মাথা থেকে বের হয়ে সখিনার রূপ-যৌবনের দিকে ড্যাবড্যাব চোখে তাকিয়ে থেকে জিহবা চাটতে থাকে মুড়ার গিদরগুলি। মা সাজেদা বেগমকে হাঁস-মুরগি পালনে, বাঁশ ও বেত দিয়ে হাঁড়ি, কুলা, টুকরি, চালুন, ঢোল-জাবার, আনতা, ভিওর, পলো, ডোলা ইত্যাদি পণ্য তৈরিতে সহযোগিতা করত সখিনা। সন্ধ্যার বেশ আগে আগেই হাঁসগুলিকে ডেকে নিয়ে আসার জন্য প্রায় প্রতিদিনই বাড়ির বিচালি পাড় হয়ে লাল মাটির পথ ধরে লোঙ্গার পাশে ডোবার পাড় যেতে হতো তাকে। কারণ একটু দেরি হলেই আড়ার ভেতর থেকে বের হয়ে আসবে দু‘একটি বুধি শেয়াল। শেয়ালগুলিও মুড়ার গিদরগুলির মতোই লোভি। চকচকে চোখে আলো জে¦লে সন্তর্পনে গলা বরাবর কামড়ে ধরে আবার পালিয়ে যাবে ঝুঁপের আড়ালে। তাছাড়া বাড়ির চারা-বিচালির আশপাশ হতে বিভিন্ন শাক-লতা তুলতেও যেতে হতো সখিনাকে। তখন সখিনার হাঁসগুলির জন্য ওত পেতে বসে থাকা শেয়ালগুলির মতোই যেন কাঁঠাল-লেচু কিংবা লেবু বনের আড়ালে ওত পেতে বসে থাকত গিদরগুলি। কুরুচিপূর্ণ অঙ্গ-ভঙ্গি ও বিভিন্ন আকার-ইঙ্গিতের মাধ্যমে সখিনাকে প্রেম নিবেদন করত ওরা। কিন্তু সখিনার হৃদয়ে সামান্যতম কোন অবকাশ ছিল না সেই গিদরগুলির কারোর জন্য। খুব বেশি এগিয়ে এসেছিল সীমান্তের রমিজ উদ্দিন। চকচকে কামুক-লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকত সখিনার শরীরের দিকে। সুযোগ পেলেই যেন তার হাঁসগুলির গলা কামড়ে ধরা লোভাতুর শেয়ালগুলির মতো সখিনাকে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যাবে ঝুঁপ-জঙ্গলের আড়ালে। রমিজ উদ্দিনের চরিত্র সম্পর্কে সখিনার জানা হয়ে গিয়েছিল আরো আগেই। ততদিনে সখিনা মন দিয়ে বসেছিল ফকির হাটির শফিকুলকে। শফিকুলও ভালোবাসার আহবান জানিয়েছিল সখিনাকে। বয়সের ভারে কাবু হয়ে যাওয়াতে সখিনাদের হাতে তৈরি বাঁশ-বেতের পণ্যগুলিকে দূরের বাজারে নিয়ে বিক্রি করতে রহম আলীকে সহযোগিতা করত শফিকুল। নিজের সন্তানের মতই তাকে আদর করত রহম আলী। পিতৃহীন এতিম বালক শফিকুল। তবে তার বাবা বাঘা পীরের মাজার ভক্ত মানুষ ছিল। সেই তরিকা সূত্র ধরেই তাদের খাতির-জমা হয়েছিল রহম আলীর পরিবারের সাথে। অসুস্থ মাকে নিয়ে ফকির হাটিতেই থাকত শফিকুল। অর্থ-সম্পদ বলতে ছিটে-ফোটাও ছিল না তার। লোঙ্গা-ছড়ার কৃষি জমিতে দুই এক মাসের বেশি কামলা খাটা সম্ভব ছিল না। বাদ-বাকি সময় বেকার থাকলে চলবে কি করে দুটি পেট! তাই একদিন রহম আলীর বাড়িতে এসে তার মা-ই অনুরোধ করে বলেছিল তার ছেলেটাকে যেন বাঁশ-বেতের পণ্য বিক্রির কাজে লাগিয়ে দেন। রহম আলী নির্ধারিত বেতনের চুক্তিতে শফিকুলকে নিয়ে দূর-দূরান্তের হাটে যেতে থাকে পণ্য বিক্রি করতে। এতে রহম আলীর বিক্রি-বাট্টা কিছুটা বৃদ্ধি পায় সেই সাথে শফিকুলেরও একটি কর্মসংস্থান হয়। কিছুদিন যেতে না যেতেই শফিকুল-সখিনার মন দেয়া নেয়ার বিষয়টি টের পায় রহম আলী ও তার স্ত্রী। তখন শফিকুলের মাকে ডেকে বিষয়টি অবগত করলে তাদের উভয় পক্ষের মতামতের ভিত্তিতে শফিকুলের সাথে বিয়ে হয় সখিনার। রহম-সাজেদার হাতে নিজ সন্তানের ভার দিয়ে এর কয়েকদিন পরই দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করে শফিকুলের মা। তারা সখিনা-শফিকুলকে তাদের উত্তরাধিকার মনে করে নিজ পেটের সন্তানের মতো ভালাবাসা দিয়ে-তাদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে এসেছিল। চারটি মানুষ মিলে তখন রহম আলীর-বলতে গেলে শফিকুলের সংসার ভালোই চলছিল। কিন্তু মুখ দিলেন যিনি দুঃখ দিবেন তিনি এ পাঠ তো জানা ছিল না রহম আলীর। কে বা কাদের কু-পরামর্শ গ্রহণ করে শ^শুরের সাথে বাঁশ-বেতের পণ্য নিয়ে হাট-বাজারে যেতে অস্বীকৃত জানাল শফিকুল। সে বায়না ধরল ভার-বোঝার কাজে তার পোষাবে না। সে শহরে যাবে। সেখানে কাঠের ফার্নিসারের দোকান করবে। একমাত্র মেয়ে সখিনার সুখের কথা চিন্তা করে শফিকুলের কথামতো তাকে ফার্নিসারের দোকান করার জন্য পুজি প্রদান করে রহম আলী। এ পুজির যোগান দিতে তার একমাত্র ভূমি সম্পদ পুর্বলোঙ্গার দু‘বিঘে জমি ছাড়াও বাছুরসহ একমাত্র গাই গরুটিকে বিক্রি করতে হয়। রহম আলীকে সম্পদহীন করে পুজি নিয়ে ফার্নিসারের ব্যবসার নাম করে ঢাকা শহর যায় শফিকুল। ঢাকা যাওয়ার পর হতেই শফিকুলের আচার-আচরণে দেখা দিতে থাকে পরিবর্তন। সেজামুড়ায় শ^শুর বাড়িতে গর্ভবতী স্ত্রীকে রেখে শ^শুরের দেয়া পুজি নিয়ে গিয়ে সামান্যতম যোগাযোগ রক্ষাও করে নি শফিকুল। মাজারের খাদেম সাহেবের মাধ্যমে বেশ ক‘টি চিঠি লিখে পাঠিয়েও কোন উত্তর পায় নি সখিনা। ততদিনে সখিনার কোলজুড়ে এলো একটি কন্যা সন্তান। হঠাৎ করে সাজেদা বেগম অচল হল অর্ধুইঙ্গা বাতাস লেগে। বাঘা পীরের মাজারের খাদেম সাহেবের তেলপড়া ও পানিপড়াসহ ঝাড়-ফুক নিতে কিঞ্চিত কার্পণ্য করেনি বেচারা রহম আলী। কিন্তু সাজেদা বেগমের একটি পা ও একটি হাত সম্পূর্ণরূপে প্যারালাইসিস হয়ে গেল। বয়সের ভারে এবং শরীরে হাঁপানি বাসা বাঁধার কারণে রহম আলীও আর বাঁশ কেটে কাঁধে করে নিয়ে গিয়ে হাটে বিক্রি করতে পারে না। অভাবের অমানিষা তার থাবা বিস্তৃত করে ঝাপিয়ে পড়ে তার সংসারে। শফিকুলের নবজাতক কন্যাসহ চারটি প্রাণির অন্ন যোগানো কঠিন হয়ে পড়ে রহম আলীর জন্য। অভাবের কারণে কিছু দিনের মধ্যেই ভিটে-বাড়িটা ছাড়া সামান্য বিচালিটুকুও বিক্রি করে সর্বশান্ত হতে হয় রহম আলীকে। অভাবের তাড়না শান্ত-শিষ্ট সখিনাকেও বিচলিত করে তোলে। চারটি প্রাণির মুখে খাদ্য তুলে দিতে বৈধ কোন কাজের সন্ধান পায় নি সখিনা। সখিনার যে কোন একটি বৈধ কাজে সহযোগিতা কামনা করে তার উত্তরাধিকারকে সত্য-সুন্দর ও ইজ্জত-সম্মানের পথে পরিচালিত করতে হাঁপাতে হাঁপাতে বারবার বাঘা পীরের মাজারে গিয়ে মাথা কুটেছে রহম আলী। মোনাজাত করেছে দুই হাত তোলে। কোন একটি কাজ করে গা-গতরে খেটে দুটি পয়সা রোজগারের জন্য চেষ্টার সামান্যতম ত্রুটি করেনি সখিনা। শেষে এগিয়ে এলো সীমান্তবর্তী গ্রাম বিষ্ণুপুরের স্বামী পরিত্যক্তা মহিলা জোবেদা। তবে তা বাঘা পীরের সুদৃষ্টি ও আর্শিবাদে কি না সেটা বুঝা গেল না। জোবেদা ছাড়াও তাদের দলে কাজ করে খাদিজা, রাফিয়া, সাফিয়াসহ আরো বেশ কয়েকটি অসহায় নারী। জোবেদা তাকে নিয়ে যায় তাদের ব্ল্যাকিং কারবের লিডার রমিজ উদ্দিনের কাছে। এ যেন যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই সন্ধ্যা হয়। সখিনাকে দেখে যেন পুরনো নেশাটা চকমকিয়ে উঠে রমিজ উদ্দিনের চোখে-মুখে। টের পায় সখিনা। তবু মাথা নুয়ে বসে থাকে সে পুরনো শাড়িতে যতটা সম্ভব আব্রু টেনে চিন্তাক্লিষ্ট বদনে। রমিজ উদ্দিন এ লাইনে পাক্কা মানুষ। চেকপোষ্টের বিডিআর (বিজিবি), বিএসএফ, ফাঁড়ির পুলিশসহ সীমান্ত এলাকার সব ধরনের চোর-সেচ্চর ও গুন্ডা-বদমাইশ সকলের সাথে তার অলিখিত খাতির-জমা করা আছে। এ লাইনে কাজ করতে হলে রমিজ উদ্দিনের দলে নাম লেখানো ছাড়া প্রতিপদে বিপদ। এ পাড় হতে মাছ-শুটকি নিয়ে গিয়ে ওপাওে পৌঁছিয়ে দিয়ে ওপার হতে চিনি-মসল্লা-শাড়ি ও নেশাজাত দ্রব্য গাজা-ফেন্সিডিল নিয়ে আসতে বিডিআর-বিএসএফ এর হাতে ধরা পরলে একমাত্র ভরসা রমিজ উদ্দিন। শোনা যায় শহরের কোন কোন নেতা পাতি নেতার সাথেও নাকি খাতির-সদ্ভাব আছে তার। শিশু কন্যা, বৃদ্ধ বাবা ও আতুর মাকে বাড়িতে রেখে রাত নাই, দিন নাই সীমান্ত এলাকায় অপমান অসম্মান ও পার-গুতা খাওয়ার ঝুঁকি নিয়ে ছুটে বেড়াতে হচ্ছিল সখিনাকে। এ জন্য সেজামুড়াতে বদনাম ও সমাজের চোখে কম খেয় প্রতিপণ্য হতে হচ্ছে না সখিনা ও তার মা-বাবাকে। কিন্তু সমাজের এ সব বদনামের চোখ রাঙ্গানিকে আমলে আনলে পেট চলবে কিভাবে সখিনাদের। তাই কানে শিসা ঢেলে কান বন্ধ করে, বিবেকের চোখে কালো কাপড় বেধে ব্লাকিং কাজের পিছে ছুটে চলে সখিনা। এভাবেও না চলার ভেতর একরকম চলে যাচ্ছিল। এর মধ্যে খবর পায় সখিনা যে, শফিকুল তার বাবার কাছ থেকে টাকা-পয়সা নিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য কিছুই করেনি। বরং এসব টাকা-পয়সা খারাপ পথে খরচ করে শেষ করেছে। এবং সে সেখানে গোপনে আরেকটি বিয়েও করেছে। তার সে তরফের স্ত্রীর গর্ভেও একটি কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণ করেছে। এবং তাকে নাকি ব্রাহ্মণবাড়িয়াতেও মাঝে মধ্যে ঘোরাফেরা করতে দেখেছে কেউ কেউ। অথচ সেজামুড়ার দিকে সে ফিরেও তাকায় না তার স্ত্রী-কন্যার কোন প্রকার খোঁজ-খবর ও তক্ত-তালাপি নিতে।
ব্লাকিং এর মালামাল পাচার করতে গিয়ে কোন কোন সময় অনেক রাত হয়ে যায়। তখন আর সেজামুড়ায় ফিরতে পারে না সখিনা। জোবেদার সাথে বিষ্ণুবপুরই রাত কাটাতে হয়। পদে পদে তার দুশ্চিন্তা ও নিরাপত্তার অভাব। আর এ লাইনের চোর-সেচ্চর, গুন্ডা-বদমাইশদের তো চরিত্র বলতে কিছুই নেই। চেকপোষ্ট ভাতা, ফাঁড়ি ভাতা, রমিজ উদ্দিনের লিডার ভাতা এসব দিয়ে ক‘টি টাকাই বা থাকে এ সমস্ত ব্লাকার মেয়েদের হাতে। তার উপর আবার শরীরের দিকে কু-দৃষ্টি দেয় হারামির পোলারা। সখিনার অভাবক্লিষ্ট ও চিন্তাক্লিষ্ট ভগ্ন অথচ ফর্সা শরীরের দিকে কু-নজর তো লেগেই আছে স্বয়ং সীমান্ত লিডার রমিজ উদ্দিনের। তাদের কু-প্রস্তাবের কথা জোবেদাকে জানালে জোবেদা সংক্ষেপে সখিনাকে যা বোঝায় তা হলো-বোনরে অভাবের কারণে আমরা ব্লাক লাইনে কাজ করি। আমাদের কি আর মান-ইজ্জত-সম্ভ্রম বলতে কিছু আছে? মান-ইজ্জত না থাকলে শরীর বাঁচিয়ে রাখব কার জন্যে। আর রমিজ উদ্দিনের চোখ যখন তোর উপর পরেছে তখন এ লাইনে কাজ করতে হলে তাকে খুশি করেই তোর কাজ করতে হবে। শফিকুলের উপর তার অন্তর্গত অভিমানের কারণে কিনা বলা যায় না। তবে চরম অনিচ্ছা সত্ত্বেও কোন উপায়-অন্তর না দেখে রমিজ উদ্দিনকে মাঝে মধ্যে খুশি তাকে করতেই হতো। এটাও তার গা সওয়া হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু একটি বিষয় কিছু দিনের মধ্যেই পরিস্কার হয়ে গিয়েছিল সখিনার কাছে। অন্ধকারের পথে পা বাড়ালে পিছনের দিকে আলোর সামান্যতম রেখাটিও আর অবশিষ্ট থাকে না। ব্লাকিং করার পাশাপাশি রমিজ উদ্দিনের কারসাজিতে তার কোন কোন বন্ধুর বিছানায় যেতেও বাধ্য করা হলো সখিনাকে। রমিজ উদ্দিনের যুক্তি হলো- ময়লার গন্ধ অল্পই কি আর বেশিই কি। ময়লা তো ময়লাই। কাকে গু একবার খাওয়া আর শতবার খাওয়া, এক স্থানে খাওয়া আর শতস্থানে খাওয়ার মধ্যে কোন ফারাক নেই। সুতরাং ব্লাকিং লাইনে কাজ করতে এসে একজনকে খুশি করা যে কথা একাধিককে করা তো একই কথা। তাই রমিজ উদ্দিনের সেই জঘণ্য পথ হতে নিস্তার পায় না সখিনা।
বুঝতে পারে সখিনা; রমিজ তার বন্ধুদের খুশি করার নামে সখিনাকে দিয়ে এ নোংরা পথ থেকেও ইনকাম করে টু-পাইস। টাকা ইনকাম করে জোবেদা, খাদিজা, রাফিয়া, সাফিয়াসহ আরো অনেক অসহায় নারীর অভাবের সুযোগ নিয়ে তাদের সোনার দেহকে পুজি করে। সকলেই সহ্য করে মুখবুঁজে।
কোন এক রাতে রমিজ সখিনাকে রাজি করায় তার এক নতুন বন্ধুকে খুশি করানোর জন্য। তার শিশু কন্যাটি সেজামুড়ায় অসুস্থ। আতুর হয়ে পড়ে রয়েছে তার মা। বৃদ্ধ বাবার হাঁপানিটাও বেশ বেড়েছে। তাকে বাড়ি ফিরতেই হবে ইত্যাদি শত অযুহাত ও অনুনয়-বিনয় করার পরও নিস্তার পায় নি সখিনা। বরং উল্টো যুক্তি দেখায় রমিজ। সে জন্যই তো তুকে আজ রাত সীমান্তে কাটিয়ে যেতে বলছি। আজ না হয় কিছু টাকা বাড়িয়ে দিবনে। টাকা নিয়ে খাবার ও ওষুধ-পাতি কিনে সকালে বাড়ি যাস। তুই তো তাদের ভালোই চাস। ভালো চায়লে টাকা ছাড়া তাদের ভালো কিভাবে করবি তুই? বলে অগ্রিম কিছু টাকা সখিনার হাতে গুজে দেয় রমিজ। চরম অনিচ্ছার কাছে মাথানত করতে বাধ্য হয় সখিনা।
সীমান্তের কাছে আড়া-জঙ্গল আর ঝোপ-ঝাড়ে ছাওয়া রমিজের লাল মাটির দেয়াল ঘরের অন্ধকার কোটায় সখিনার ক্লান্ত-ক্লিষ্ট শ্রান্ত শরীরের দিকে হাত বাড়ায় রমিজ উদ্দিনের নতুন বন্ধুটি। কানের নরম লতি, গাড় ও গলা পেরিয়ে পিঠ ও ঠান্ডা বুকের দিকে একটি বিষধর সাপের মতো এগিয়ে যেতে থাকে নতুন লোকটির হাত দুটি। তবে খুব চেনা চেনা লাগে তার কাছে হাত দুটিকে। সে যেন এ হাতের ছোঁয়া আগেও কোথায় অনুভব করেছে। পার্থক্য শুধু তখন হাত দুটিকে তার কাছে মনে হয়েছে আদুরে আর উষ্ণতায় ভরপুর। আর আজ যেন হিংস্রতা আর ঠান্ডায় সর্প শরীরের মতো। রমিজের বন্ধুটির মনের ভেতরও যেন খেলা করে যাচ্ছে পুরনো কোন খেলা। তার কাছেও যেন মেয়েটির শরীরের সমস্ত পথ-ঘাট পরিচিত ঠেকছে। সে যেন এ পথ-ঘাটে অতীতে অনেক হেঁটেছে। দূর-ঝাঁপ করেছে এ শরীর সরোবরে খায়েস মিটিয়ে। আজ কেন যেন সেই চেনাচেনা লাগা পরিচিত পথেও হাঁটতে বেশ ক্লান্তিবোধ করছে সে। পা দুটি যেন জড়িয়ে আসছে বারবার মুড়ার বনোলতায়। নিজের কাছে নিজকে পরাজিত সৈনিকের মতো মনে হচ্ছে। শেষে রণে ভঙ্গ দিয়ে চৌকির কোণে স্তুপ করে রাখা শার্টের পকেট হাতড়ে একটি সিগারেট বের করল সে। তারপর সেটাতে আগুন ধরাবার জন্য গ্যাস লাইটের খুঁটে যখনই বাড়ি দিল তখনই অন্ধকার দূর হয়ে গিয়ে বেশ স্পষ্ট হয়ে দেখা দিল সখিনার ফিকে হয়ে যাওয়া গোলাপি রঙের অর্ধনগ্ন চেহারাটা। সখিনাও নিমিষে এক নজর দেখে নিল শফিকুলের কুৎসিত ও ক্লেদাক্ত মুখশ্রীটি। কিন্তু কোন কথা সরেনি তার মুখ হতে। স্তব্ধ হয়ে গেল সে। অন্ধকার আবরণের কারণে কেউ কারো মুখ দর্শন পুনরায় আর করতে পারে নি। তাই তার স্বামীর উঁচু মাথা অন্ধকারের ভেতর নুয়ে নিচু হয়ে পড়েছে কি না তা সখিনা দেখতে না পারলেও শফিকুলের শিরদাড়া বেয়ে নিচের দিকে নেমে গেল বরফের মতো হিম চিনচিনে একটা ধারা। বিবেকের অনুভুতি দিয়ে বুঝতে সক্ষম হল যে তার ভালোবাসার প্রিয়তমা স্ত্রী সখিনা তার জঘণ্য কু-প্রবৃত্তির কারণেই রমিজ উদ্দিনের দেহ সঙ্গীনী হওয়াসহ আজ সীমান্ত ব্লাকার ও বেশ্যাবৃত্তিতে নিয়োজিত।
লেখক সম্পর্কে

-
লেখক পরিচিতি-
আমির হোসেন ১৯৭৩ সালে ৫ জানুয়ারি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগর উপজেলার গৌরনগর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মো. সুরুজ মিয়া ও মাতার নাম গুলবরের নেছা। তিনি ১৯৯৬ সালে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতে অনার্সসহ এম এস সি ডিগ্রী অর্জন করেন। পরবর্তীতে তিনি ২০০৩ সালে বি এড ও ২০১৫ সালে এল এল বি ডিগ্রী অর্জন করেন।
প্রকাশিত গ্রন্থ- নিমন্ত্রিত তমসা (কবিতা), ঝরাফুলের সুরভি (উপন্যাস), দার্শনিক কবি মাশরেকীর জীবন ও সাধনা (গবেষণা), ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার ইতিহাস (গবেষণা), জলময়ূরীর পেখম (গল্প), জলের গহীনে নীল জোছনা (কবিতা), মালালার আর্তনাদ (উপন্যাস), তোমার হরিণমায়া চোখ (গল্প), চালাক কুমির ও বোকা শেয়াল (শিশুতোষ গল্প), সিঁদুরের দেয়াল (উপন্যাস), রমেশ ঋষির সংসার (গল্প), ক্লান্তিহীন এক অভিযাত্রী মোকতাদির চৌধুরী (গবেষণা), ছোটদের বঙ্গবন্ধু (গবেষণা), সুখ নগরের সারথি (কবিতা), বাঁশির সুরে পরীর নাচ (শিশুতোষ) ও তিতাস পাড়ের গল্প (গবেষণা), মুক্তিযুদ্ধের গল্প (গল্প), মায়াবী মদিরাক্ষী ( কবিতা), বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবার (গবেষণা), বৃহন্নলা (উপন্যাস) ও হিরালী ও অন্যান্য গল্প (গল্প) ।
সম্পদনা- স্বদেশ, মিডিয়া ওয়ার্ল্ড, চিনাইরবার্তা ডটকম ও শোকাঞ্জলি।
তিনি ২০০৮ সালে দৈনিক যুগান্তর পত্রিকার (স্বজন সমাবেশ) বর্ষ সেরা লেখক সম্মাননা, ২০১৩ সালে তিতাস আবৃত্তি সংঠন সম্মননা পদক, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ২০১৪ সালে জননী সাহিত্য পদক, রাজশাহী, ২০১৪ সালে ইদ্রিস খান স্মৃতি সম্মননা পদক, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ২০১৪ সালে কবি এম. আমজাদ আলী স্মৃতি পদক, রাজশাহী, ২০১৫ সালে ‘মেঠোপথ’ সাহিত্য পদক কিশোরগঞ্জ, ২০১৮ সালে বেস্ট লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানী পুরস্কার ও ২০১৯ সালে সুমিতা সাহিত্যপত্র সম্মাননা, আগরতলা, ত্রিপুরা, ভারত লাভ করেন। তিনি শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন।
সর্বশেষ লেখা
গল্প২০২২.০২.০৯পাগলি – আমির হোসেন
গল্প২০২০.০৯.১১শাকিলার দু’চোখ ঝাপসা হয়ে আসে – আমির হোসেন
গল্প২০২০.০৯.১১উত্তরাধিকার – আমির হোসেন
গল্প২০২০.০৮.২৫অনন্ত অভিমুখে – আমির হোসেন