ধর্ষিতা
– আমির হোসেন
ট্রেন থেকে এক প্রকার টানাটানি করেই সুটকেসটি প্লাটফরমে নামাল তরুন ইন্সপেক্টর ফরহাদ। বেশ ভারীও বটে। রাত ক’টা বাজে এখন? হাতে ঘড়ি আছে। কিন্তু দেখা মনে হয় সম্ভব হবে না। স্টেশনে বিদ্যুৎ নেই। আকাশে মেঘ ভাঙা চাঁদ। ছেড়া ছেড়া মেঘের আড়ালে লুকোচুরি করছে চাঁদের আলো। মেঘে ঢাকা ধোঁয়াসাময় আলোতে ঘড়ির কাঁটা কতটার ঘরে অবস্থান করছে তা বুঝা কষ্টকর হবে। তবে রাত নিশ্চয় বারটার কম হবে না। সুটকেসটা বহন করার জন্য এত রাতে কুলি বা মেন্তি পাওয়া যাবে বলেও মনে হয় না। তবে নামার পর তার শরীরে ঠান্ডা একটা বাতাসের ঝাঁপটা এসে লাগল। জ্যৈষ্ঠের ভ্যাপসা গরম দিনের বেলা তো আছেই। ক‘দিন ধরে রাতেও যেন গায়ে এসে লাগে তাপে পোড়া বাতাস। এরকম একটা অস্বস্থিকর গরমের মধ্যে দীর্ঘ পথ ট্রেন জার্নি করার পর প্রবাহিত ঠান্ডা বাতাসের ঝাঁপটাটা বেশ আরামদায়ক মনে হলো ফরহাদের কাছে। এদিক ওদিক তাকাল। পেসেঞ্জারও যে খুব একটা বেশি করে এ স্টেশনে নেমেছে তা নয়। অল্প কিছু পেসেঞ্জার নেমে বিক্ষিপ্তভাবে যার যার গন্তব্য মেপেছে। বাতাসের ঠান্ডা ঝাঁপটা সামান্য বিরতি দিয়ে দিয়েই পুনরায় এসে তার শরীরে লাগছে। বেশ আরাম লাগছিল। এত রাত হওয়ার পরও স্টেশন থেকে এই ভারী সুটকেস নিয়ে বের হওয়ার কোন তাড়া নেই যেন তার। একটা সিগারেট ধরালে কেমন হয়? কিন্তু বাতাসের ঝাঁপটার জন্য আগুন জ্বালানো সম্ভব হবে কিনা কে জানে? দু‘করতল দিয়ে মাকু আকৃতি তৈরি করে দেয়াশলাইয়ের কাঠিটি জ্বালাল ফরহাদ। বেশ আরাম করে সিগারেটে টান দিচ্ছে সে। সুটকেস নিয়ে কিভাবে যে ডাক বাংলোয় যাবে তা যে সে ভাবছে না তা-ও নয়। ডাক বাংলোতে যেতে পারলে রাতটা পার করা যাবে। পরের দিন সকালে সুন্দর ভাবেই বাস কিংবা লেগুনা দিয়ে ত্রিশাল যেতে পারবে। না গেলেও সমস্যা নেই। ত্রিশাল থানায় গিয়ে জয়েন করার জন্য আরও একটা দিন সময় আছে তার হাতে। প্রয়োজনে ডাক বাংলোই একদিন থেকে ময়মনসিংহের দর্শনীয় স্থানগুলি দেখে নিতে পারবে। পরের দিন যাবে ত্রিশাল ।
গত দু‘দিন আগে নবীনগর থানা থেকে স্টেন রিলিজ করা হয়েছে ইন্সপেক্টর ফরহাদকে। পোষ্টিং দেয়া হয়েছে ময়মনসিংহের ত্রিশাল থানায়। বিকেলে থানার ঘাট থেকে ভাড়া করা স্পিট বুট দিয়ে ভৈরব বাজার চলে এসেছিল সে। নবীগর থেকে লঞ্চ ছাড়াও এখন তিতাস নদীর উপর দিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া গোকর্ণ ঘাট এবং তিতাস-মেঘনা নদীর উপর দিয়ে ভৈরব পর্যন্ত অত্যন্ত দ্রুত গতিতে ভাড়া চালিত স্পিট বুট চলাচল করে থাকে। যাদের হাতে সময় খুব কম তারা সাধারণত স্পিট বুট দিয়েই যাতায়াত করে থাকেন। ফরহাদও অত্যন্ত অল্প সময়েই ভৈরব বাজার চলে এসেছিল। ভৈরব বাজার স্পিট বুট ঘাট থেকে রিকশা করে রেলওয়ে জংশন। সেখান থেকে সন্ধা হয় হয় সময়ে ময়মনসিংহ এক্সপ্রেস ট্রেনটি ছেড়েছিল। কিন্তু ময়মনসিংহ রেলওয়ে স্টেশন পর্যন্ত আসতে যে ট্রেনটির এতটা সময় লাগাবে তা ভাবেনি ফরহাদ। নয়লে বিকল্প হিসেবে বিভিন্ন পরিবহনের বাস ছিল। সর্বোচ্চ তিন ঘন্টার মধ্যে পৌঁছে যেত সে। এসব কথা ভাবতে ভাবতে তাঁর হাতের সিগারেট শেষ হয়ে আসল প্রায়। এমন সময় সালাম দিয়ে সামনে এসে দাঁড়াল এক তরুন। স্যার আমার নাম ইউসুফ। আমার রিকশা আছে। ঐ যে রিকশা ওখানে রেখে আসছি। বলে ইউসুফ আঙুল দিয়ে স্টেশনের বাইরের দিকটি দেখাল। আমি অনেক্ষণ ধরে আপনার জন্য অপেক্ষা করতেছি স্যার। আপনি সিগারেট ধরিয়েছেন বলে আমি আগাইয়া আসিনি। ভাবলাম স্যারে সিগারেটটা শেষ করে নিক। তারপর না-হয় স্যারকে নিয়ে যাব। স্যার আপনি কোথায় যাবেন? ফরহাদ লক্ষ্য করল রিকশার ড্রাইভার ইউসুফ যে তার সাথে কথা বলছে কেমন যেন পরিচিত পরিচিত ভঙ্গিতে। শুদ্ধ অশুদ্ধ মিশিয়ে কথা বলছে ইউসুফ। কিছু কিছু শব্দ জোর করে শুদ্ধ বলার চেষ্টা করছে। স্টেশনে বিদ্যুৎ না থাকায় তার চেহারা স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে না। তবে বয়সের তুলনায় একটু বয়স্কের ছাপ লক্ষ্য করা গেল তার মাঝে। অতিরিক্ত পরিশ্রম করার ফলে এমনি হয় কারো কারো ক্ষেত্রে। তবে ইউসুফ যে কিছুটা হলেও লেখাপড়া জানে তা তার কথাবার্তায় বোঝা গেল। হয়তো অন্য কোন উপায়-অন্তর নেই বলেই সে রিকশা চালাচ্ছে।
-ইউসুফ মিয়া তুমি কি ময়মনসিংহ ডাক বাংলো চিন?
-জ্বি স্যার। চিনি স্যার। আমি ময়মনসিংঙ্গা ছাওয়াল স্যার। এই শহরের বেক রাস্তা আমার জানা স্যার। আমার বাড়ি ত্রিশাল থানার লামাপাড়ায়।
-তোমার বাড়ি ত্রিশাল?
-জ্বি স্যার।
-আমি তো ত্রিশালই যাবো। ত্রিশাল থানায় দারোগা হিসেবে বদলি হয়ে এসেছি। এর আগে নবীনগর ছিলাম।
-জ্বি স্যার নবীনগর আমার পরিচিত জায়গা। বিয়ে শাদি করার আগে আমি নবীনগর ছোট্ট একটা ব্যবসা করতাম স্যার। সেখানে আমার প্রত্রিকার এজেন্ট ছিল স্যার। ভালোই চলত পত্রিকার ব্যবসা। পত্রিকার এজেন্ট ছেড়ে এখন রিকশা চালাও কেন তুমি?
-এজেন্ট ব্যবসা এখনো ছাড়ি নাই স্যার।
-তাহলে?
-দিনের বেলা আমি পত্র-পত্রিকা নিয়েই থাকি। তবে রাতের বেলা কিছুক্ষণ রিকশা চালাই স্যার। আমার সংসারটা স্যার একটু বড়। বৃদ্ধ বাবা-মা ছাড়াও সংসারে আছে আমার সাইমা এবং ছেলেপুলেরা। সাইমা নামটা শুনে একবার ভাবল ফরহাদ।
-সাইমা!
জ্বি স্যার। সাইমা আমার স্ত্রী। এরপর আমাদের গরীব মানুষদেরতো ছেলে মেয়ে একটু বেশিই হয় স্যার। দু‘টি ছেলে ও দু‘টি মেয়ে নিয়ে আট-নয় জনের সংসার স্যার। একার পরিশ্রমে চলে না স্যার। তাই দিনের বেলা পত্রিকার কাজ শেষ হলে রাতে কয়েক ঘন্টা রিকশা চালাই।
তই এ শহরেই জীবন কাটাইলাম স্যার। মধ্যে দু‘দিন বছর খালি নবীনগর ছিলাম। সাইমার সাথে আমার বিয়ে হওয়ার পর আমি আর নবীনগর থাকি নাই স্যার। আমি ত স্যার লেখাপড়া কিছু জানি। পত্রিকার এজেন্ট ছিল বলে প্রচুর পত্র-পত্রিকা পড়ার সুযোগ ছিল। একদিন দেখলাম চিত্র বাংলায় মনের কথা বলিতে ব্যাকুল পাতায় সাইমা কলম বন্ধু হতে চাই বলে চিঠি দিল। আমি উত্তর দিলাম স্যার। পেন ফ্রেন্ড থেকে স্যার প্রেম। এরপর একদিন ওকে বিয়ে করে ফেললাম। তই পরিশ্রম করলেও আমার মনের মধ্যে কোন দুঃখ নেই । সাইমা আমার খুব ভালো বউ স্যার। এত অভাবের মধ্যেও আমাদের মধ্যে মিল-মহব্বতের কোন কমতি নেই। ভালোবাসার কমতি থাকলে কি স্যার সংসার সুখের হয় কোনদিন?
-ও ! কিছু একটা বলতে গিয়েও থামল ফরহাদ।
-আমি কি আপনাকে ডাক বাংলোতেই নিয়ে যাব স্যার? বলে সুটকেসটার দিকে এগিয়ে গেল ইউসুফ মিয়া।
-হে আমাকে তুমি ডাক বাংলোতেই নিয়ে যাবা।
ইউসুফ মিয়া একটানে সুটকেসটাকে কাঁধে তুলে নিল। ফরহাদ তাকে অনুসরন করতে থাকলো। রিকশায় বসে ফরহাদ বলল, ইউসুফ মিয়া তুমি তো আবার দিনের বেলায় রিকশা চালাও না।
-সচরাচর চালাই না স্যার। তবে কোন বিশেষ প্রয়োজনে চালাতে আমার কোন আপত্তি থাকে না। আল্লাহ যেহেতু পেট দিয়েছেন। তই পেটের জোগার ত করতেই হবে স্যার। সেখানে লজ্জা শরম রাইখয়া কি লাভ। বলেন ত স্যার কি করতে হবে?
-না বলছিলাম কি, আমাকে আগামীকাল ত্রিশাল না গেলেও চলবে। আমার হাতে আরও একটা দিন সময় আছে। তুমি যেহেতু ময়মনসিংহ শহরের সব কিছু চেন জান, তোমাকে নিয়েই না হয় আগামী দিনটি ঘুরে ফিরে কাটিয়ে দিতাম। একদিনে এখানকার দর্শনীয় স্থানগুলির প্রধান প্রধান গুলি একবার দেখে নিতাম। কি কি দর্শনীয় স্থান আছে এখানে ইউসুফ মিয়া?
-অনেক আছে আমাগো ময়মনসিংহে স্যার। ঐতিহাসিক শশীলজ রাজবাড়ি। এটা স্যার এখন ম্যাডামগোর ট্রেনিং সেন্টার। ব্রহ্মপুত্র নদও ময়মনসিংহের দর্শনীয় স্থানগুলি মধ্যে অন্যতম। শিল্পী জয়নুল আবেদিনের স্মৃতি বিজড়িত নদ স্যার। এ নদের পশ্চিম তীরে শহরের একেবাবে পূর্ব প্রান্তে শিল্পীর নামে জাদুঘর আছে স্যার। তিনি তো ছবি এঁকে দেশ জোড়া নাম করে গেছেন। তার আঁকা দুর্ভিক্ষের ছবি তো স্যার বিশ্ব বিখ্যাত। তার মতো গুণী শিল্পী আংগুর ময়মনসিংহের গৌবর।
হে ইউসুফ মিয়া শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন ছিলেন এদেশের বিরল প্রতিভা। তিনি ছিলেন বাঙালির গর্বের ধন। রং তুলির আঁচড়ে আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে এদেশকে এঁকেছেন। সেখানে ভাড়া নৌকায় নদ পাড় হয়ে পূর্ব তীরে গেলে স্যার কাশফুলের দীগন্ত জোড়া মাঠ দেখে আপনার মন-প্রাণ জুড়িয়ে যাবে। এছাড়া ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়তো আছেই। বেকগুলি আপনি একদিনে দেখে শেষ করতে পারবেন না স্যার। আপনি চায়লে আমি কাল সারাদিন আপনাকে নিয়ে ঘুরে বেড়াতে পাড়ি স্যার। আপনারা শিক্ষিত মানুষ। আপনাদের সাথে ঘুরতে পারলেও জ্ঞান-বুদ্ধি বৃদ্ধি পায় স্যার।
-তোমার প্রত্রিকা ব্যবসার ক্ষতি হবে না?
-তা হবে না স্যার। চালাইয়া নিতে পারব। সিস্টেম করা আছে। পোলাপানদের শিখাইয়া রাখছি। হকার পোলাপান স্যার। মাঝে মাঝে আমি না থাকলেও পোলাপানে চালাইয়া নিতে পারে।
-ঠিক আছে আগামীকাল আমি তোমাকে সাথে নিয়েই ঘুরবো ইউসুফ মিয়া। মনের সুখে ঘুরে ঘুরে একটি দিন কাটিয়ে দেব কি বল?
-জ্বি স্যার। কথা বলতে বলতে ইউসুফ মিয়ার রিকশা এসে ডাক বাংলোর সামনে থামলো। রিকশা থামিয়ে ইউসুফ মিয়া বলল, স্যার দাড়োয়ান এখন পর্যন্ত সজাগ না-ও থাকতে পারে। আপনি বসুন, আমি চেষ্টা করে দেখি তাকে ডেকে তোলা যায় কি-না? ফরহাদ রিকশায় বসে আর একটি সিগারেট জ্বালাল। ইউসুফ মিয়া ডেকে ডুকে কিভাবে যেন দাড়োয়ানকে নিয়ে এলো। দাড়োয়ান গেট খুলল। চোখ কচলাতে কচলাতে ঘুম ভাঙা চোখে বলল, স্যার আপনি নবীনগর থেকে এসেছেন? আপনার কথা ত্রিশাল থানা থেকে বলা আছে। আপনার ট্রেন নিশ্চয় বেশ লেইট করেছে।
-হ বেশ লেইট করেছে মনে হচেছ। ফরহাদ এর খেয়াল হলো ইউসুফ মিয়ার সাথে গল্প জুড়ে যাওয়ায় ঘড়িতে ক‘টা বাজে আর তা দেখা হয়নি। দাড়োয়ানকে বলল, ধর তো তোমার টর্চটা আমার হাতের দিকে। দেখি ক‘টা বাজে। দাড়োয়ান টর্চ টিপলে ফরহাদ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেল। দেখলো ঘড়িতে ঘন্টার কাঁটা তিনটার ঘর পাড় করেছে।
অনেক রাত হয়ে গেছে দাড়োয়ান। আজকের ট্রেন সত্যিই বেশ লেইট করেছে।
-আমার নাম রাজা মিয়া স্যার। অ রাজা মিয়া? ওকে। রাজা মিয়া সুটকেস নিয়ে বাংলোর দু‘তলার দিকে চলে গেল। ফরহাদ ইউসুফ মিয়ার হাতে একশত একটি টাকার নোট গুজে দিলো। ইউসুফ মিয়া বুঝতে পারছিল না কত টাকা ভাড়া রাখবে? নাকি সবটাই তাকে দিয়ে দিয়েছেন? ইউসুফ মিয়ার ইতঃস্ততা বুঝতে পেরে ফরহাদ বলল, সবটাই তোমার ইউসুফ মিয়া। রেখে দাও। আর আজ যা রাত হয়েছে। সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠা মনে হয় সম্ভব হবে না। তবু পারলে তুমি সকাল নয়টার মধ্যে চলে আসার চেষ্টা করবা। ইউসুফ মিয়া হ্যাঁ সূচক মাথা নেড়ে সালাম দিয়ে গিয়ে রিকশার হেন্ডলে হাত রাখল। ফরহাদ দু‘তলায় গিয়ে তার নির্ধারিত রুমে ঢুকে কাপড়-চোপড় ছাড়ল। বাথরুমে প্রবেশ করল। হাত-মুখ ধুয়ে এসে খাটের কিনারায় বসল। রাজা মিয়া এসে বলল, স্যার এত রাতে তো ভাত ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে। তরকারিও ঠান্ডা। আপনি কি এসব খেতে পারবেন? আপনার খাবার-দাবাড়ের জন্য এখন কি জোগার করব বুঝতে পারছি না স্যার।
-তোমাকে কোন কিছু জোগার করতে হবে না রাজা মিয়া। এতরাতে কোথাও আমার জন্য কেউ গরম ভাত-তরকারি রান্না করে রাখেনি। উপস্থিত কোন কিছু থেকে থাকলে দাও। আর না থাকলে চলবে। রাত শেষ হতেই আর কতক্ষণ?
ফরহাদ ব্রহ্মপুত্র নদের পাবদা মাছের তরকারি দিয়ে এক প্লেট ঠান্ডা ভাত খেয়ে নিল। খেয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিল। জার্নির একটা ক্লান্তি তার মধ্যে কাজ করছিল। ক্লান্তিতে দু‘চোখ মুদে আসতে চাইছে। তখন তার খেয়াল হলো স্টেশনে যে রিকশাওয়ালা ইউসুফ বলেছিল, তার স্ত্রীর নাম সাইমা। পেন ফ্রেন্ড থেকে প্রেম। এরপর বিয়ে। ধক ধক করে উঠলো ফরহাদের বুকটা। তবে কি তার হারিয়ে যাওয়া সাইমাই এই রিকশাওয়ালা স্ত্রী। সাইমা তার সাথে প্রতারণা করেছিল সত্য। তার বান্ধবী নীলাকে সে চিঠিতে বলে গিয়েছিল সে তার পেন ফ্রেন্ড এর হাত ধরে পালিয়েছে। কোনদিন সাইমাকে সে ক্ষমাও করতে পারবে না। তাই বলে তাকে ফেলে সে রিকশাওয়ালার হাত ধরে পালিয়ে এসেছিল? সাইমা তার সাথে প্রতারণা করেছে। এ জন্য তার কোন খোঁজ খবরও আর নেওয়ার প্রয়োজন অনুভব করেনি ফরহাদ। আজ দীর্ঘদিন পরে জীবনের একটি বিশেষ পর্যায়ে এসে তার ভেতরটা কেমন নাড়া দিতে লাগলো সাইমা। ইউসুফ মিয়ার শেষ বাক্যটি মনে হতে লাগলো ‘ভালোবাসা না থাকলে কি আর সংসার সুখের হয়? তাহলে কি ফরহাদের ভালোবাসায় কোনরুপ খাত ছিল!
ফরহাদের মনের পর্দায় ছায়া ছবির মতো এক এক করে ভাসছে তার স্কুল জীবন-কলেজ জীবন সব। কুমিল্লার ক্যান্টনমেন্ট এলাকার সিল্ক ফাউন্ডেশনে সুপারভাইজার পদে চাকরি করত তার বাবা তবারক উল্লাহ। তখন ফরহাদ ক্যান্টনমেন্ট ইস্পাহানী স্কুলে দশম শ্রেণির ছাত্র। মা-বাবার সাথে ফাউন্ডেশন এলাকাতেই বসবাস করত ফরহাদ। ফাউন্ডেশন এলাকার একটু দক্ষিণ দিকে রাণী কুটির স্কুলে পড়ত সাইমা। এলাকার পূর্ব-উত্তর দিকের শহর তলির মতো এলাকাটিতেই ছিল সাইমাদের বাসা। এসব সুত্র ধরেই ফরহাদের সাথে সাইমার দেখা। দেখাদেখি থেকে ভালোলাগা, ভালোলাগা থেকে ভালোবাসা।
কত স্মৃতি যে দুঃখ গাথা হয়ে আছে ক্যান্টনমেন্টের প্রকৃতির আনাচে কানাচে। ওয়ার সেমিট্টির উঁচু বেদীতে, ইটাখোলা মোড়ার ক্ষয়ে যাওয়া লাল সিড়িতে, শালবন বিহার, বৌদ্ধ বিহার, নীলাচল পাহাড় আর গোমতী নদীর তীরের সবুজ ঘাসের শরীর ছুঁয়ে ছুঁয়ে।
কত মধুময়ইনা সে সব স্মৃতিগুলি। আর আজ কেবলি স্মৃতি ভঙ্গের দুঃখ। কেবলি স্মৃতির ভেতর দুঃখের সাগরে সাঁতার কাটা। স্মৃতির অতলে হারানো মানিক খুঁজতে গিয়ে ভাবনার অতলে তাকায় ফরহাদ। দেখে শুল্কা পক্ষের চাঁদ নিবু নিবু আলোয় তাকে যেন করছে উপহাস। সে যেন ভীষণ নিঃসঙ্গ। আর নিঃসঙ্গ রাতের ভাবনাগুলি তার কেঁদে উঠছে গোপন হাহাকারে। স্মৃতির অলিন্দে ভেসে উঠছে তার অখন্ড মৌনতা। ছাইচাপা পড়া তার দুঃখগুলিকে যেন ঘৃতাহুতি দিলো ইউসুফ মিয়া। সাইমা ইউসুফ মিয়ার স্ত্রী! সত্যিই যদি তা হয়। এর সত্যি সত্তা যাচায় করার একটা ইচ্ছাও ইতিমধ্যেই জাগ্রত হয়েছে ফরহাদের মনে। এসব ভাবতে ভাবতে টের পায় ফরহাদ-তার হৃৎপিন্ডে রক্ত ক্ষরণের ফোঁটা ফোঁটা শব্দ। তার ভাবনার সীমানা পেরিয়ে রাত্রী প্রায় শেষ প্রহরের কাছাকাছি। প্রকৃতি দেবী তখন নিদ্রাদেবীর কোলে সমর্পিত। থেকে থেকে ভেসে আসছে দূরে কুকুরের একটানা কান্নার শব্দ। আর এই অশ্বনী সংকেতকে কেন্দ্র করে পশলা পশলা বাতাস আছড়ে পড়ছে ডাক বাংলোর বাতায়নে। একাকি জেগে আছে ফরহাদ। ঘুম আসছে না তার অতন্ত্র দু‘টি আঁখিতে। এমনি করে কত যে প্রহরের পর প্রহর হত্যা করেছে ফরহাদ সাইমার কথা ভেবে ভেবে। স্মৃতির শেষ তীরে দাঁড়িয়ে ফরহাদের হৃদ মন্দির সম্পূর্ণ শূন্য। স্মৃতির প্রতিটা পরতে পরতে সাইমার অবস্থান থেকেও সে আজ তার থেকে যোজন যোজন দূরে। সাইমাকে দীর্ঘদিন ভালোবেসে পরিণয়ের মধুর সুতোয় আবদ্ধ করতেই চেয়েছিল ফরহাদ। পত্র-পুস্পে মঞ্জুরিত করতে, বিকশিত করতেই চেয়েছিল এ জীবন। তাই সাইমার সাথে সুখে দুখে একাকার হয়ে পাঁচটি বছর কাটিয়ে দিয়েছিল ফরহাদ। সাইমাকে বসাতে চেয়েছিল তার হৃদ মন্দিরের হিরন্ময় দেবীর আসনে। প্রেমের কালজয়ী উপাখ্যান রচনা করতে চেয়েছিল তাকে নিয়ে। তাকে সাজাতে চেয়েছিল শিল্পীর তুলির পোছে ফরহাদ তার নিজস্ব মোনালিসা করে। সাইমাকে ঘিরেই তৈরি করতে চেয়েছিল সে তার সমগ্র সৃষ্টি। সেই হৃদয়ের মায়াবিণী কি-না সহসায় উলট-পালট করে দিয়েছিল ফরহাদের স্বপ্নের পৃথিবী। ভালোবাসার এমন মায়াবী সুতাটিকে এক ঝটকায় ছিড়ে কিভাবে সাইমা উড়ে গেল তথাকথিত কলম বন্ধুর হাত ধরে!
তাকে আজ খুব মনে পড়ছে ফরহাদের। কতবার যে গোমতী নদীর তীরে হাতে হাত রেখে ঘুরে বেড়িয়েছে ফরহাদ আর সাইমা। চমৎকার শান্ত-¯িœগ্ধ-নির্জন পরিবেশ তখন গোমতীর তীর। একপাশে ঝোপঝাড়, অদূরে সবুজ বনভূমি। তারপর রুপালি ফিতের মতো আঁকা-বাঁকা হয়ে বয়ে গেছে ঝকঝকে ছোট্ট এ নদীটি। নদীর ওপারে ফসলের সবুজ মাঠ। এরপর গ্রাম। মানুষের বসতি। তীরে লোকজনের আনাগুনা নেই তেমন। ফরহাদের স্পষ্ট মনে পড়ছে-সেদিন ছিল শীতের কোন এক দুপুর। মেঘমুক্ত আকাশ। সূর্যটা কিরণ ছড়াচ্ছিল নরম রোদের। পরিবেশটাকে মধুময় করে তুলেছিল ঝির ঝিরে হালকা পবন। এ ছিল এক সোনালি দুপুর। বড়ই আরামের এই দুপুর। ঝির ঝিরে বাতাসটা একটা হালকা ঢেউয়ের সৃষ্টি করেছিল ঝোপ-ঝাড়ের উপর। এ এক অতুলনীয় মনোরম দৃশ্য। চারপাশে ফুটেছিল নানা জাতের বনজ ফুল। এমন মনকারা চমৎকার পরিবেশে কতবার যে যুগল বন্দী হয়ে কাটিয়েছে সময় কেবল ফরহাদ আর সাইমা। ফরহাদ সত্যিই ফিরে যায় তার হারানো সেই দিনের স্মৃতিতে। কেবল দু‘টি নর আর নারী। নির্জনতায় শুধুই ওরা দু‘জন। সাইমা হেঁটে হেঁটে আশপাশটা একবার দেখে। ওর চোখে মুখে মুগ্ধতার ছোঁয়া। এদিকে ফোটে থাকা বনজ ফুলের উপর রং-বেরঙের নানা প্রকার প্রজাপতির ওড়াওড়ি পরিবেশটিকে রুমান্টিক থেকে রুমান্টিকতর করে তুলেছিল। এক সময় ওরা পরস্পরের পাশ ঘেষে বসে। শীতের নদী। স্থির তার জল। জলের ভেতর আকাশ দেখা যাচ্ছিল। সমস্ত আকাশটায় ছিল সাদা নীল মেঘের অলস ওড়াওড়ি। রেশমি তুলোর মতো আকাশ তার ছাঁয়া ফেলছিল নদীর উপর। ফরহাদ বলল, দেখছো সাইমা। আকাশ কেমন ছাঁয়া ফেলেছে নদীর স্থির জলে। মনে হচ্ছে না এখানে আমরা সারাদিন বসে থাকি। তোমার কি মনে হয়? সাইমা চুপ করে থাকে।
-কিছু বলছ না যে? কি ভাবছো আনমনে। আমার পাশে বসে থাকতে তোমার ভালো লাগছে না বুঝি?
-তাই বুঝি ভাবছি?
-তবে কথা বলছ না যে? ফরহাদ ম্লান হেসে তার ডান হাতটাকে সাপের মতো লতিয়ে নেয় সাইমার মসৃন নিটোল গ্রীবার উপর।
-দুষ্টুমি শুরু করলে? উহু! তবে ছাড়।
-যদি না ছাড়ি?
-তবে চিৎকার করব।
-তা-ই বুঝি?
-জ্বি তাই।
-তোমার চিৎকার এখানে কেউ শুনবে না।
-শুনবে।
-কে শুনবে?
-প্রজাপতি, ফড়িং এরা শুনবে। ফরহাদের হাতটা আরো খানিকটা বেশি পেছিয়ে ধরে সাইমার গলাটা। আচ্ছা বলতো সাইমা আমাদের বিয়ের পরও কি তুমি
চিৎকার করে প্রজাপতি, ফড়িং এদের শুনিয়ে দিবে? বিয়ের কথা শুনেই সাইমা কেমন যেন আনমনা হয়ে যায়। বলে বিয়ে——।
-হে বিয়ে।
-বিয়ে মানে ইয়ে। বলে প্রসঙ্গ পাল্টায় সাইমা। বলে এই চলনা আমরা নদীর তীর ধরে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করি। এজ ইউ লাইক বলে দু‘জনই ওঠে পড়ে। পায়ের নীচে দূর্বা ঘাস। মৃদু বাতাসে ঘাসের ডগাগুলি দোলছে হরিণের শ্বাস লেগে দোলার মতো। নদীর তীর ধরে হাঁটতে হাঁটতে ফরহাদ বলল, দেখতে পাচ্ছ সাইমা, নদীর জল কি চিক চিক করছে। তোমার ইচ্ছে করে না এখানেই থেকে যাই অনন্ত কালের জন্য। দু‘জন মিলে মিশে গড়ে তুলি আমাদের স্বপ্নের পৃথিবী। তুমি রঙিন কলসি কাহে চিক চিকে কালো জল ভরে ফিরবে এই বুনো ঝুপের ভিতর দিয়ে আঁকা বাঁকা পথে। তীরের অদূরে সোনার পাতায় ছাওয়া আমাদের প্রেমের তাজমহল। যমুনার তীরে বাদশাহ হুররুম শাহ ও মমতাজ মহলের শ্বেত পাথরের তৈরি তাজমহল আর গোমতীর তীরে ফরহাদ-সাইমার সোনার পাতায় ছাওয়া সোনার তাজমহল। পড়নে থাকবে লাল বেনারশী। বিকেলের সোনা গলা রোদ চুইয়ে পড়বে তোমার চিবুক রাঙিয়ে। তোমার নাকের পশ্চাতে বিকেলের রোদে জমে উঠবে মুক্তো দানার মতো ঘাম জড়ানো শিশির। সাইমা হাঁটছে আর মন্ত্র মুগ্ধের মতো শুনছে ফরহাদের কল্পনা বিলাস কথা। সাইমা মনে মনে হাসছে। কারণ সে জানে ফরহাদ প্রকৃতি প্রেমিক মানুষ। এবং সে খুবই কল্পনা বিলাসী। সর্বোপরি মন ভোলাও বটে। এখন নদীর তীর ধরে হাঁটছে। তাই নদীই তার কাছে পৃথিবীর সকল সুন্দরের শ্রেষ্ঠ সুন্দর। এখন নদী সম্পর্কে তাকে কথা বলতে দিলে বিশাল এক এসাইনমেন্ট তৈরি করে ফেলবে- সুপ্রাচীন কাল থেকে এ দেশের মানুষ নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে তুলেছে তাদের বসতি। গড়ে তুলেছে সভ্যতা আর জীবন। পদœা-মেঘনা-যমুনা সহ অসংখ্য নদী পাহাড় ভেঙে চড়াই অতিক্রম করে চঞ্চলা ঝর্ণা সমতলে এসে নদী নাম ধারণ করে প্রবাহিত করছে বাংলাদেশের জীবনকে। কখনো নদী অভিমান করে ফিরিয়ে নিয়েছে মুখ তা-ও মানুষের নির্মমতায়। আবার নতুন দিকে————ইত্যাদি। তারপর এক সময় ফরহাদ হয়তো অন্য কোন সৌন্দর্য প্রেমে বিভুর হয়ে পড়বে। নদী আর বেলা ভূমি পরে থাকবে যার যার মতো। এভাবেই কেটে যাচ্ছিল ফরহাদ-সাইমার স্বপ্ন বিভোর দিনগুলি।
কিন্তু সুখ দিল যিনি দুঃখ দিবেন তিনি। এ পাঠ জানা ছিল না ফরহাদের। ফরহাদের তখন এম এস সি ফাইনাল পরীক্ষা সামনে। কত স্বপ্ন আর কত কল্পনায় ভরপুর তার মন। আর মাত্র ক‘টি মাস। তার পরীক্ষা শেষ হয়ে যাবে। ফলাফল প্রকাশ পেলে যে কোন একটা চাকরি জুটিয়ে ফেলবে সে। সাইমাও ইতিমধ্যেই ইন্টামিডিয়েট পাশ করে ফেলছে। এরপর আর কোন বাধাই থাকবে। মা-বাবাকে দিয়ে প্রস্তাব পাঠাবে সাইমাদের বাড়ি। সানাই বাজিয়ে বউ করে ঘরে তুলে আনবে সাইমাকে। গড়ে তুলবে সুখের স্বর্গ। এমনই চিন্তায় যখন মগ্ন-বিভোর ফরহাদ ঠিক তখনই এক বিকেলে রাণী কুঠির মাঠে ফরহাদকে ডেকে পাঠাল সাইমা। স্বাভাবিক-স্বতঃস্ফুর্ত ভঙিতে বলল, ফরহাদ তুমি যদি আজ-কালকার মধ্যে আমাকে নিয়ে পালিয়ে না যাও তাহলে তোমার আমার মিলন কোনদিনও সম্ভব হবে না। বাবা-মা আমার বিয়ে ঠিক করেছে অন্য জায়গায়। তুমি যদি আমাকে নিয়ে পালিয়ে যেতে রাজি না থাক তবে জেনে রেখ, আমিই বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যাবো যেদিকে চোখ যায়।
-তুমি এসব কি বলছ সাইমা। আর মাত্র দু‘টি মাস বাকি আমার এম.এস. সি. পরীক্ষা। পরীক্ষা শেষে আমি নিশ্চিত একটা চাকরি জোগার করে ফেলব। তখন তোমাকে আমি বউ করে ঘরে তুলে আনব। তাছাড়া আমরা পালিয়ে বিয়ে করব কেন? আমরাতো প্রস্তাবের মাধ্যমেই বিয়ে করতে পারি।
-থাক তোমার চাকরি নিয়ে আর প্রস্তাব নিয়ে। তোমার মনে হয় চাকরির সাথেই ঘর-সংসার করতে হতে পারে। বলে সাইমা তর তর করতে করতে রাণী কুঠির মাঠ পার হয়ে নিচু রাস্তায় নেমে গেল। ফরহাদ সাইমাকে আর কোন ভাবে বোঝানোর সুযোগও পেল না। ভেবে নিল দু‘একদিন গেলে সব ঠিক হয়ে যাবে। রাতে অনেকবার সাইমার নম্বরে যোগাযোগ করার চেষ্টা করল ফরহাদ। সাইমা ফোন বন্ধ করে রাখল। ফরহাদ শেষ পর্যন্ত সাইমার বান্ধবী নীলাকে ফোন করল। বলল, নীলা তোমার বান্ধবী সাইমার মতিগতি তেমন ভাল মনে হচ্ছে না। বিকেলে রাণী কুঠির মাঠে কি সব উল্টা-পাল্টা বলে গেল। এখন আবার মোবাইল বন্ধ করে রেখেছে। তুমি আগামীকাল দশটার দিকে একটু রাণী কুঠির মাঠের দিকে আসতে পারবে?
নীলা সহাস্যে বলল, পারব জনাব। আমার তো মনে হচ্ছে সাইমা বানুর সাথে একরাত যোগাযোগ বিচ্ছন্ন হয়ে আপনি হতাশার মহাগহবরে পতিত হয়ে গেছেন। আমি আগামীকাল দশটায় রাণী কুঠির মাঠে আসছি। রাজরাণী সাইমার সব খোঁজ-খবর নিয়েই আসবো। আপনি মাত্র কয়েকটি ঘন্টা শান্ত থাকুন। প্রয়োজনে আমি সাইমা রাণীকে নিয়েই রাণী কুঠির মাঠে দশটায় উপস্থিত হবো।
পরের দিন সকাল সকাল আশে-পাশে জানাজানি হয়ে গেলো। সাইমাকে খোঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সাইমা নীলার কাছে ছোট্ট একটি চিরকুট লিখে জানিয়ে গেছে- নীলা তুকে তো আমি প্রায়ই আমার কলম বন্ধুটার কথা বলতাম। আসলে আমি কিভাবে যে তার প্রেমেই মজতে থাকলাম। ফরহাদের ভালোবাসা আমার কাছে বুরিং লাগতে শুরু করছে। গতকাল রাণী কুঠির মাঠে আমি ফরহাদকে আমার বিয়ের ব্যপারে মিথ্যা বলেছিলাম। আমি জানতাম ফরহাদ আমাকে এ মুহূর্তে বিয়ে করতে রাজি হবে না। আর তার কাছ হতে আমি সরাসরি বিচ্ছিন্ন হতেও পারছিলাম না। তাই এই প্রতারণার পথ বেছে নিলাম। আমার মা-বাবা, ফরহাদ কেউ আমাকে আর খুঁজে পাবে না। ফরহাদের সাথে যদি দেখা হয় তাহলে বলিস আমাকে যেন ভুলে যায়। আর পারলে যেন ক্ষমা করে দেয়।
সব শোনে ফরহাদ সত্যি সত্যিই মহাগহবরের অতলে তলিয়ে যেতে থাকলো।
পরের দিন সকাল সকাল এসে ডাক বাংলোও উপস্থিত হলো ইউসুফ মিয়া। রাতে মোটেই ঘুম হয়নি ফরহাদের। বারবার কেবল মনে হতে থাকলো সাইমার কথা। সাইমা কি তবে সত্যি সত্যি এই রিকশাওয়ালা ইউসুফের হাত ধরে পালিয়ে এসেছিল। সে-তো আর কোন দিন সাইমার কোন খোঁজও করেনি। না-কি শুধু শুধুই এমন ভাবনা। মনে মনে ঠিক করলো কিছুই জিজ্ঞেস করবে না ইউসুফকে। ত্রিশাল থানায় যখন তার পোষ্টিং হয়েছে আর ইউসুফের বাড়িও যেহেতু ত্রিশাল লামাপাড়ায় বলেছে। তাহলে ইউসুফের স্ত্রী যদি সত্যিই তার সাইমা হয় তাকে আবিস্কার করা কোন কঠিন কাজ হবে না।
রিকশায় বসে প্রথমেই কৃষি বিদ্যালয় ক্যাম্পাসে গেলো ফরহাদ। গেইট দিয়ে ঢুকতেই গবাদি পশুর খামার নজরে আসল। একটি সেটে লেখা প্রজননক্ষম ষাড়ের সেট। বেশ কয়েকটি বিদেশী জাতের ষাড় রয়েছে সেটটিতে। এরপর পশ্চিম দিকে এগোতে থকলো রিকশা। দু‘ধারে বিভিন্ন জাতের ধানের ক্ষেতের সবুজ প্রদর্শনী প্লট। তাদের রিকশাটিকে ওভার টেক করে করে এগিয়ে গেল একটি সাইকেল আরোহী ছাত্রীদের বহর। প্রত্যেকটি ছাত্রীর পড়নে ধব ধবে সাদা হাফ প্যান্ট ও গায়ে সাদা হাফ হাতা গেঞ্জি। নিপুন কায়দায় সাইকেল চালাচ্ছিল তারা। একই তালে পেডেলে পা রাখার কারণে তাদের ফর্সা উরু ও বক্ষদেশের ছন্দময় দুলোনি একটি বড় রকমের নাড়া দিয়ে যায় ফরহাদের মনোজমিনে। এরপর সারি সারি আম বাগান আর দিগন্ত জোড়া পরিকল্পিত ফসলের প্রদর্শনী মাঠ ঘুরে এসে রিকশা থেকে নামল স্বাধীনতা ভাস্কর্যের সামনে। ছবি উঠাল বেশ ক‘টি। সবশেষে জব্বারের মোড়ে এসে পৌঁছাল। বড় বড় গাছের নিচে বেঞ্চ ফেলে রাখা হয়েছে চায়ের দোকানের সামনে। সেখানে বসে এক কাপ চা খেলো ফরহাদ। ইউসুফকে দিলো এক কাপ। এরপর রিকশাটি আবার ব্রহ্মপুত্র নদের তীরের পশ্চিম পাশের রাস্তা দিয়ে চলতে থাকল শশীলজ রাজ বাড়ির উদ্দেশ্যে।
সকালের রুপাগলা রোদ তখন ব্রহ্মপুত্রের জলে যেন খেলা করছে। দেখতে দেখতে শশীলজ রাজবাড়ির ফটকের সামনে গিয়ে থামল রিকশাটি। ফটকের দু‘পাশে দু‘টি প্রাচীন বৃক্ষই বলে দিচ্ছে শশীলজের ঐতিহাসিক গুরুত্বের কথা। প্রাচীন স্থাপত্যের নিদর্শন এ রাজ বাড়িটি দেখা শেষ হলে ইউসুফ বলল, স্যার এখন আপনাকে নিয়ে যাব শিল্পী জয়নুল আবেদিন স্মৃতি জাদুঘরে। চিত্র শিল্পী জয়নুল আবেদিন স্মরণে এ জাদুঘর তৈরি করা হয়েছিল স্যার। তিনি নাকি দুর্ভিক্ষের প্রচুর ছবি এঁকেছিলেন। এবং এসব ছবির জন্য তিনি বিখ্যাত হয়ে আছেন। তিনি আংগু ময়মনসিংহের মানুষ স্যার। ছবি-টবির বিষয় আমি না বুঝলেও স্যার আমার সাইমা এ সব ভালো বুঝে। হের আগ্রহেই স্যার আমি প্রথম প্রথম হেরে নিয়ে বেশ ক‘বার জাদুঘর দেখতে গেছি। জাদুঘর দেখা শেষ করে পাল তোলা নৌকা করে ব্রহ্মপুত্র নদ পার হয়ে কাশফুলের বন দেখতে গেছি স্যার। কাশ ফুল আবার সাইমার খুব প্রিয়। এখন তো আর ঘুরাঘুরির সময় হয় না। বাচ্চা-কাচ্চা আর সংসার নিয়েই তো হের ব্যস্ত থাকতে অয় স্যার। ইউসুফ মিয়ার বলে যাওয়া কথা শুনতে শুনতে ফরহাদ ভাবছিল তাহলে কি সত্যিই এই রিকশাওয়ালার সাইমাই তার হারিয়ে যাওয়া সাইমা! হবে হয়তো। অথবা না। রিকশাটি ইতিমধ্যেই জয়নুল আবেদিন স্মৃতি জাদুঘরের সামনে চলে আসছে। জাদুঘর দেখা শেষে ফরহাদ নৌকা করে ব্রহ্মপুত্রের অপর তীরে দিগন্ত জোড়া কাশ ফুলের বন দেখতে গেল। এভাবে সারাদিন তার কেটে গেল ঘুরে ফিরে। বাংলোতে ফিরে সারাদিনের ক্লান্তির কারণে সকাল সকালই ঘুমুতে গেল। পরের দিন ইউসুফ এসে তার সুটকেস সহ তাকে ত্রিশালের লেগুনায় উঠিয়ে দিয়ে গেল। বলল, স্যার আমি দু‘একদিনের মধ্যেই বাড়ি আসতেছি। আপনাকে কিন্তু লামাপাড়া যেতে হবে স্যার। আমি ত্রিশাল থানায় গিয়ে আপনাকে নিয়ে আসব। আমার সাইমার হাতের এক কাপ চা খেয়ে আসতে হবে। সাইমা খুব ভালো চা বানাতে পারে স্যার। সুযোগ করে একদিন যাবে বলে ফরহাদ মাথা নাড়ল।
ত্রিশাল থানায় জয়েন করে বেশ ভালোই লাগছিল নতুন স্থানের চাকরি ফরহাদের। থানার ওসি জাফর আলী সাহেব বেশ আন্তরিক ও সহযোগী মানুষ। দু‘ এক দিনের মধ্যেই ফরহাদ তার কাছ থেকে এ এলাকা সম্পর্কে একটা সম্যক জ্ঞান লাভ করলো। এর মধ্যে দু‘একটি মামলার তদন্ত ভারও গ্রহণ করেছে সে। কাজের ফাঁকে আবার তার মনে হচ্ছিল যে, ইউসুফ যদি সত্যিই একবার থানায় আসত তাহলে একবার লামাপাড়ায় যাওয়া যেত। যেতে পারলে সাইমা সংক্রান্ত যে গোলক ধাঁধাঁ ইতিমধ্যে তার মনের মধ্যে তৈরি হয়েছে তার সত্যি-সত্তা যাচাই হয়ে যেত। তাছাড়া ইউসুফ মিয়ার ইচ্ছাও পুরণ হতো। তার যেহেতু খুব ইচ্ছা তার স্ত্রীর হাতের চা ফরহাদকে খাওয়ানোর। এমন সব বিক্ষিপ্ত কথাবার্তা ভাবছিলো ফরহাদ, এমন সময় ওসি জাফর আলী সাহেব ডেকে পাঠালেন ফরহাদকে। বললেন, ইয়াং ইন্সপেক্টর লামাপাড়ায় একটা বড় রকমের অপরাধ সংগঠিত হয়েছে। সেখানে ইউসুফ নামের এক রিকশার ড্রাইভারের স্ত্রী র্দুবৃত্ত কতৃক ধর্ষিত হয়েছে। গরীব রিকশা চালক ময়মনসিংহ শহরে রিকশা চালায়। রাতে সেখানেই থাকে। বাড়িতে তার স্ত্রী রাতের বেলা প্রকৃতির ডাকে বের হলে চার পাঁচ পাষন্ড মিলে মহিলাকে স্থানীয় একটি পরিত্যাক্ত গোদাম ঘরে নিয়ে যায়। সেখানে তাকে রাতভর পালা করে ধর্ষণ করে। অচেতন অবস্থায় ভিক্টিমকে ময়মনসিংহ সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। আপনি এখনই সদরে চলে যান। মহিলার একটা জবান বন্ধি ফাইল করে নিয়ে আসবেন। ওকে?
-ওকে স্যার। কয়েক মিনিটের মধ্যেই ফরহাদ দু‘জন সিপাইকে সাথে নিয়ে রওয়ানা হয়ে গেল। হাসপাতালের নির্ধারিত কক্ষে প্রবেশ করতেই প্রায় ছুটে এসে ফরহাদকে জড়িয়ে ধরে হাও মাও করে কাঁদতে শুরু করল ইউসুফ মিয়া। স্যার আপনি আসছেন? আসুন স্যার। দেখুন। এই আমার প্রিয়তমা সাইমা স্যার। যাকে আমি ভালোবেসে বিয়ে করেছিলাম। যার হাতের চা আপনাকে খাওয়াতে চেয়েছিলাম স্যার। বলে সিক বেডের কাছে এক প্রকার টেনে ফরহাদকে নিয়ে গেল ইউসুফ মিয়া। সিক বেডে প্রায় অচেতন অবস্থায় শুয়ে আছে সাইমা। ঠিক আগের সেই স্্্্াইমা। খুব একটা পরিবর্তন হয়নি তার চেহারায়। কেবল চার পাঁচটি সন্তান ধারণের ছাপ আর অভাবের আবাস ফোঁটে আছে চোখে মুখে। ডাগর ডাগর চোখ দু‘টি আগের মতোই রয়ে গেছে সাইমার। যে চোখে এক সময় চোখ পড়েছিল ফরহাদের। সেই চোখ দিয়ে ফরহাদের দিকে তাকিয়ে আছে সাইমা।
-তুমি আমায় চিনতে পারছ সাইমা?
সাইমা কোন কথা বলতে পারছিল না। তবে তার দু‘চোখের চাহনি বলে দিচ্ছিল যে সে ফরহাদকে ভালো করেই চিনতে পেরেছে।
-সাইমা আমি ফরহাদ। তোমার ততক্ষণাত বিয়ের প্রস্তাবে আমি রাজি হয়নি বলে তুমি রাতের আঁধারে পালিয়ে এসেছিলে। আমি নীলার কাছ থেকে সব শুনে আর তোমাকে খোঁজতে যাইনি। তোমার সাথে এ অবস্থায় আমার দেখা হবে তা আমি কখনো ভাবিনি সাইমা। আমি ত্রিশাল থানায় ইন্সপেক্টর হিসেবে জয়েন করেছি। তোমার স্বামী ইউসুফ মিয়া আমাকে চা-খাওয়ার দাওয়াত দিয়েছিল। তুমি নাকি খুব ভালো চা বানাতে পার। খুব শিঘ্রই আমার তোমাদের লামাপাড়ায় যাওয়ার কথা ছিল। টানা এতগুলি কথা বলে আবার সাইমাকে জিজ্ঞেস করলো ফরহাদ-তুমি কি আমাকে চিনতে পারনি সাইমা?
অনেক কষ্টে জবাব দিলো সাইমা- আমি তোমাকে চিনতে পেরেছি ফরহাদ। এমন করুণ অবস্থায় আমি আজ তোমার মুখোমুখি। আমি আজ ধর্ষিতা। পাষন্ডদের বর্বর নির্যাতনে আমি আজ জীবন-মরণের মাঝামাঝি। তোমার সাথে প্রতারণার প্রতিফল আমি ভোগ করেছি ফরহাদ। যদি পার আমাকে ক্ষমা করে দিও। বলে দু‘হাতে মুখ ঢাকলো সাইমা। দু‘করতলে ঢাকা মুখ হতে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নার আওয়াজ এসে ছোঁয়ে ছোঁয়ে যাচ্ছিল ফরহাদের শ্রবণ সীমানা।
লেখক সম্পর্কে

-
লেখক পরিচিতি-
আমির হোসেন ১৯৭৩ সালে ৫ জানুয়ারি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগর উপজেলার গৌরনগর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মো. সুরুজ মিয়া ও মাতার নাম গুলবরের নেছা। তিনি ১৯৯৬ সালে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতে অনার্সসহ এম এস সি ডিগ্রী অর্জন করেন। পরবর্তীতে তিনি ২০০৩ সালে বি এড ও ২০১৫ সালে এল এল বি ডিগ্রী অর্জন করেন।
প্রকাশিত গ্রন্থ- নিমন্ত্রিত তমসা (কবিতা), ঝরাফুলের সুরভি (উপন্যাস), দার্শনিক কবি মাশরেকীর জীবন ও সাধনা (গবেষণা), ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার ইতিহাস (গবেষণা), জলময়ূরীর পেখম (গল্প), জলের গহীনে নীল জোছনা (কবিতা), মালালার আর্তনাদ (উপন্যাস), তোমার হরিণমায়া চোখ (গল্প), চালাক কুমির ও বোকা শেয়াল (শিশুতোষ গল্প), সিঁদুরের দেয়াল (উপন্যাস), রমেশ ঋষির সংসার (গল্প), ক্লান্তিহীন এক অভিযাত্রী মোকতাদির চৌধুরী (গবেষণা), ছোটদের বঙ্গবন্ধু (গবেষণা), সুখ নগরের সারথি (কবিতা), বাঁশির সুরে পরীর নাচ (শিশুতোষ) ও তিতাস পাড়ের গল্প (গবেষণা), মুক্তিযুদ্ধের গল্প (গল্প), মায়াবী মদিরাক্ষী ( কবিতা), বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবার (গবেষণা), বৃহন্নলা (উপন্যাস) ও হিরালী ও অন্যান্য গল্প (গল্প) ।
সম্পদনা- স্বদেশ, মিডিয়া ওয়ার্ল্ড, চিনাইরবার্তা ডটকম ও শোকাঞ্জলি।
তিনি ২০০৮ সালে দৈনিক যুগান্তর পত্রিকার (স্বজন সমাবেশ) বর্ষ সেরা লেখক সম্মাননা, ২০১৩ সালে তিতাস আবৃত্তি সংঠন সম্মননা পদক, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ২০১৪ সালে জননী সাহিত্য পদক, রাজশাহী, ২০১৪ সালে ইদ্রিস খান স্মৃতি সম্মননা পদক, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ২০১৪ সালে কবি এম. আমজাদ আলী স্মৃতি পদক, রাজশাহী, ২০১৫ সালে ‘মেঠোপথ’ সাহিত্য পদক কিশোরগঞ্জ, ২০১৮ সালে বেস্ট লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানী পুরস্কার ও ২০১৯ সালে সুমিতা সাহিত্যপত্র সম্মাননা, আগরতলা, ত্রিপুরা, ভারত লাভ করেন। তিনি শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন।
সর্বশেষ লেখা
গল্প২০২২.০২.০৯পাগলি – আমির হোসেন
গল্প২০২০.০৯.১১শাকিলার দু’চোখ ঝাপসা হয়ে আসে – আমির হোসেন
গল্প২০২০.০৯.১১উত্তরাধিকার – আমির হোসেন
গল্প২০২০.০৮.২৫অনন্ত অভিমুখে – আমির হোসেন