পাগলি
আমির হোসেন

পাগলি – আমির হোসেন, কবির কলম
পাগলিটিকে কেমন যেন চেনা চেনা মনে হচ্ছিল ফেরদৌসির। কোথায় যেন ওকে দেখেছেন
তিনি। সারা শরীরময় ময়লা ঝুলির সমাহার, পড়নে তেল চিটচিেিট খয়েরী রঙের এক খানা কামিছ, নিম্নাঙ্গে দরি দিয়ে কোমরের সাথে আটকানো একখানা সাদা রঙের প্যান্ট। ময়লা আটকাতে আটকাতে ধূসর হয়ে গিয়েছে কাপড়টি। হয়ত কেউ দয়া পরবশ হয়ে পুরুষের এই প্যান্টটি দান করছে পাগলিটিকে। মাথায় উসকোখুসকো চুল। মুখ মন্ডল ভাঙ্গা, চোখ দু‘টি কোটারাগত, কপালে এক খানা কাটা দাগ স্পষ্ট। বয়সের সাথে অসামঞ্জÍস্য ভাবেই ওকে বিগত যৌবনা বলে মনে হচ্ছে ফেরদৌসির কাছে। পাগলিটি কখনো মিষ্টি কন্ঠে গান করছিল।
‘যদি সুন্দর, সুন্দর এক্কা মুখ পাইতাম
মখেশখালির পানের খিলি তারে বানাইয়া খাওয়াইতাম
নতুন মুখে নতুন কথা শুনিতে সুন্দর——-।’
কখনো ভির ভির করে কি যেন বলছিল। আবার পরক্ষণেই ভেংচি কেটে হি-হি করে হাসছিল। কিছুক্ষণ হেসে চুপ মেরে যাচ্ছিল। চুপ করে থেকে কি যেন ভাবছিল। কখনো আবার পেসেঞ্জারদের গা ঘেসে তাদের সিটে বসে যাচ্ছিল। কেউ কেউ পাগলিটির উপর মারাত্বক ভাবে চটে যাচ্ছিল। কেউ তেড়ে আসছিল ওকে মারার জন্য। সেই কমলাপুর স্টেশন থেকে তিতাস কমিউটার ট্রেনটি ছেড়ে আসার পর থেকেই পাগলি সমস্যাটি কামরার সকল প্যাসেঞ্জারের বিরক্তির কারণ হয়ে আসছিল। ওর উপর মোক্ষম অস্ত্রটি ঝেড়েছে চানাচুরওয়ালা। পাগলিটি তখন হুট করেই ফেরদৌসির পাশে ধাক্কা ধাক্কি করে গিয়ে বসে পড়ল। বসে বিচিত্র অঙ্গ ভঙ্গ করে বলল, কিলা-সই তুইও কি আমারে মারবি। আমি না তোর সই অয়। পাশে ফেরদৌসির স্বামী মোবারক সাহেব খুবই বিরক্ত হলেন। ওকে তাড়াতে চেষ্টা করছিলেন। চানাচুরওয়ালা অশ্লিল ভাষায় বলল, মার লাগান ভাই এই খানকি মাগিরে। বুঝলেন ভাইসাব এসব অইল গিয়ে মাগিগোর ভাবসাব। এখন তো কেবল সন্ধা অয়ছে। দেখবেন আর একটু রাইত অইলেই স্টেশনে পইড়া থাকা বগিগুলিরে এ সমস্ত মাগিরা পসকোয়াটার বানাইয়া ফালাইব। আর এখন মাগি পাগলি সাজছে।
ওঠ মাগি। ওঠ। নয়লে কিন্তু ঝাল কাঁচা মরিচ ভাইঙ্গা তর——।
চানাচুরওয়ালার লাগামহীন বক্তব্যে বিব্রত হয় প্যাসেঞ্জারদের কেউ কেউ। তাকে থামিয়ে দেয় ফেরদৌসি।
-তোমাকে এসব বাজে কথা বলতে কে বলেছে। চুপ কর।
পাগলিটি সম্ভবত উঠে খিস্তি খেওর দিতে যাচ্ছিল। ঠিক তখন হাত ধরে টেনে পাশে বসিয়ে দিলেন ফেরদৌসি। বলল, তুমি না আমাকে সই ডাকলা।
ডাকলা তো?
-হ ডাকলামত।
তাহলে চুপ করে আমার পাশে বসে থাক।
-বসলাম।
চানাচুর খাবা?
পাগলি কোন জবাব দিল না।
খাও ঝাল দিয়া চানাচুর।
এবারও পাগলি কোন জবাব দিলনা। ফেরদৌসি চানাচুরওয়ালাকে পাঁচ টাকার চানাচুর দিতে বলল। চানাচুরওয়ালা কৌটা হাতে নিল। কৌটায় চানাচুর, মরিচ, লেবুর রস ইত্যাদি দিল। ডান হাত দিয়ে কৌটাটি বাম হাতের তালুতে কটাস কটাস বাড়ি লাগাতে থাকল। কাগজ দিয়ে মুচড়িয়ে একটি কোণাকৃতির প্যাকেট তৈরি করল। এরপর তাতে চানাচুর ঢেলে ফেরদৌসির হাতে দিল। ফেরদৌসি পাওনা মিটিয়ে দিল। এরপর যেই পাগলি মেয়েটির হাতে চানাচুরের প্যাকেটটি দিল। ঠিক তখনই ঘটল বিপত্তটি।
হাতে পেয়েই সরাসরি চানাচুরওয়ালার মুখ-মখন্ডল বরাবর ছুড়ে মারল চানাচুরগুলি। আর মুখ দিয়ে খিস্তি খেউর দিতে থাকল এক নিঃশ্বাসে।
হারামজাদা গোলামের পুত। কাঁচা মরিচ তর মায়ের ইয়ে দিয়ে—–।
ভৈরব স্টেশনের খালি ডাব্বার (কামরা) মইদ্যে রাইত অইলে তর মায়ে আইয়া কাম দেয়। তর মত গোলামের পুতেরাইত যায় মাইয়াগোর ইয়ে লেইতে। হারামির পুত অহন সাধু সাজছে। হেরে যেন আমি চিনি না। গোলামের পুত—–।
ফেরদৌসি তখন কিংকর্তব্যবিমূঢ়। তিনি বুঝতে পারছেন যে পরিস্থিতি এখন তার নাগালের বাইরে চলে গেছে। মানসিক প্রতিবন্ধী একটি মেয়ে মানুষ খ্যাপে গেছে। তাকে নিয়ন্ত্রণ করা বেশ কঠিন। নিয়ন্ত্রণ করতে গেলে না আবার অন্য কোন অপ্রীতিকর পরিস্থিতির অবতারনা করে বসে। তার চেয়ে খিস্তি খেউর দিতে আছে, দিতে থাকুক। দিতে দিতে মনের ঝাল মিঠে গেলে এক সময় ঠান্ডা হয়ে যাবে। এবং পরিস্থিতি অনুকূলে এসে যাবে। বাস্তবেও ঘটল তা-ই। পাঁচ/সাত মিনিট টানা খিস্তি গেয়ে একবারে চুপ হয়ে গেল পাগলি। খিস্তির ভয়ে অন্যান্য পেসেঞ্জারেরাও কোন প্রকার রা করল না। খিস্তি বন্ধ করে আবার খুস করে গিয়ে বসে পড়ল ফেরদৌসির পাশে। বসে বলল, সই তুমি আবার মাইন্ড কইরঅ না। তোমরা ত সই ভদ্র মহিলা-ভদ্র লোকের ঘর কর। জগত-জীবন তোমাদের অন্যরকম।
আর আমরার জগত-জীবন, ঘর-সংসার এ সব গোলামের পুতগর লগেই। খিস্তি না দিলে গোলামের পুতেরা ঠিক তাহে না। রাইত অইলে কলাম হেরার মাইয়েরারে না অইলে গোলামের পুতেরার চলে না। রাইত অইলে হেরা গিয়া হেরার মাইয়েরার সাথে শইল্লের জ্বালা মিঠায়। এরপর ট্যাহা দেওয়নের সময় গোলামের পুতেরার কইলজায় চিপা লাগে। দেখ সই কয়ডা ট্যাহা দিয়া গোলামের পুতেরা শইলডারে কেমন কিইন্না লয়। সারাডা শইল বিষ বানাইয়া ফালাই। কামড়াইয়া দাগ ফালাইয়া দেয়। দেখনা সই হারামির পুতেরা কি করছে আমার অঙ্গডারে। বলে পাগলি তার গাল ও অর্ধ শুকিয়ে যাওয়া স্তনের কিয়দংশ দেখালো ফেরদৌসিকে। ফেরদৌসি দেখলো, পাগলির গলার নিচের দিকটি কেমন কালসিটে হয়ে আছে। কি বলে সান্তনা দিবেন তিনি এ পাগলিকে। কথা বলতে গেলেই তো যে কোন সময় লাইন ছেড়ে দিতে পাওে সে। তারপরও বলল তুমি শান্ত হওতো সই।
-তুমি না আমারে সই ডাকলা।
-হ ডাকলাম।
মসকারা করলা নাতো?
মসকারা করব কেন? তুমি কি আমার সই হতে পার না?
শাকিলা।
-কেমনে পারি! সবাইত আমারে পাগলি কই। মাগি বইল্লা ডাহে। খানকি কইয়া বহে।
তোমার সাহেব আবার তোমার উপর রাগ করব নাতো?
-রাগ করবে কেন?
-আমারে যে সই ডাকলা এ জন্যে।
-না রাগ করবে না। উনি খুব ভালো মানুষ। যখন তখন স্ত্রীর উপর রাগ করে না।
-হ সই। তুমি খুব ভাগ্যবতি মানুষ। তা-ই এমন ভাগ্যবান জামাই পাইছ। শিক্ষিত মানুষ তুমি। তাই জামাইও পাইছ শিক্ষিত। শিক্ষিত মাইনসে বউরে খুব ইজ্জত করে। সম্মান দেয়। নিজে যা খায় তারা তাদের বউরেও তা খাইতে দেয়।
আর আমারে এক গোলামের পুতে বিয়া করছিল। দুইদিন যাইতে না যাইতেই গোলামের পুতে আমারে মাইর শুরু করল। হের খালি ট্যাহার দরকার। কি সব গু মেনদরা খায় রাইত অইলে। আর দিনে কোন কাম কাইজ করে না। আমি আমার আব্বার কাছ থন হেরে ট্যাহা আইন্না দিতাম। আমার বাপ হেরে বার বার ট্যাহা দিব কইত্তন। আমিত আর বাপ মাইয়ের কথামত হেরে বিয়া করি নাই। কোন মুখে বাপ মায়ের কাছে যাইতে পারি হের লাই¹া ট্যাহা আনতে। যে বাপ মার মুখে চুন কালি দিয়া বাড়ির বাইর অইলাম। সুখের লাই¹া হের হাত ধরলাম। গোলামের পুতরে আমি চিনবার পারি নাই সই। গোলামের পুত যে একটা বাটপার। হে কথা আমি কেমনে বুঝমো। বুঝরার পারলে কি আর হের পাল্লাই পরি। হে আমার লগে প্রেমের অভিনয় করে ঘরের বাইর করল। এক সপ্তাহ যাইতে না যাইতেই সই গোলামের পুতের আসল রূপ আমি বুঝবার পারি। হে আমারে বিয়া করছে ঘর সংসার করার জন্য না। হে বিয়া করছিল আমার দেহডারে দিইক্কা। আমারে দিয়া গোলামের পুতে ট্যাহা রুজি করবার লাই।
গোলামের পুতের এমন আরও যে কত বউ কত খানে আছে তা আমি পরে টের পাই। বিয়ার নামে গোলামের পুতে নারী ব্যবসা করত। হের ছলাকলাই যে কত মেয়ের জীবন এভাবে নষ্ট হয়ছে সই তার কি কোন ইয়াত্তা আছে। জীবন যেহেতু নষ্ট অইয়া গেছে। এ নষ্ট জীবন লইয়া আর কই যামু। গোলামের পুতের কাছে থাইক্কাওতো শান্তি ছিল না। সারারাত কত নাগররে বিদায় করতে হত আমার। আর ট্যাহা লইত গোলামের পুতে। পরথম পরথম এইসব বাজে কামে আমি রাজি অইতাম না। রাজি না অইলে গোলামরে পুতে আমারে মাইর ধর করত। পলাবারও সুযোগ পাই নাই। আর পলাইয়াই বা যাইমু কই। মা বাপরে কাছে ত আমার কোন আশ্রয়রে স্থান রাখি নাই। পরে আস্তে আস্তে সহ্য অইয়া গছেলি। কন্তিু ট্যাহা পয়সা সব গোলামরে পুতে জোর করে নয়িা নতি।
এই জন্য একদিন হের ঘর ছাইড়া ঠকিই পালাইলাম। পালাইয়াও কি কোন শান্তি পাইলাম। আইয়া পরলাম অন্য গোলামের পুতেরার হাতে। এ যে দেখলা সই একটু আগে যে এক গোলামের পুতরে কেমন খিস্তি দিলাম। এ গোলামের পুতেরাও বদের হাড্ডি। রাইত অইলে গোলামের পুতেরা ঠিকই হেরার মাইয়েরার কাছে আইব। অ-কাম কু-কাম সব করব। এরপর ট্যাহা দেওনের সময় খানকির পুতেরার পহেডে ট্যাহা থাহে না। আমি সব গোলামের পুতেরারে চিনি সই। রাইত অইলে গোলামের পুতেরার চেহারা এক রকম। আর দিন অইলে আরেক রকম। দিন অইলে হারামির পুতেরা সাধু সাজে।
এ জন্য চানাচুরওয়ালা গোলামের পুতের মায়ের ইয়ে দিয়ে দিলাম—। পাগলির দুঃখের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনতে ইচ্ছে করছিল ফেরদৌসির। কিন্তু মাঝে মধ্যেই লাইন ছেড়ে বেলাইনে চলে যাচ্ছিল। তখন বিব্রত বোধ করছিলেন তিনি। কি করবে বুঝে উঠতে পারছিলেন না। তার পাশ থেকে পাগলিটি উঠছেও না। অন্য কোথাও যাচ্ছেও না। ফেরদৌসির হাজবেন্ড কিছুটা বিরক্তি নিয়ে ট্রেনের জানালা দিয়ে বাইয়ে তাকিয়ে রইয়েছেন। কিন্তু কি করবে ফেরদৌসি। তিনি তো আর এ পাগলিকে ডেকে নিয়ে আসেননি। আর এতসব বিশ্রি ঘটনার জন্য তিনি কোন প্রকার দায়িও না।
এখন কোন মতে বুঝিয়ে সুজিয়ে ওকে এখান থেকে বিদেয় করতে পারলেই না বাঁচে। তবে ব্যাটা চানাচুরওয়ালা বেশ আগেই এখান থেকে ছটকে পড়েছে। ব্যাটা হয়তো ততক্ষণে বুঝতে পেরেছে যে পাগলি যেভাবে হাঁটে হাড়ি ভাঙ্গা শুরু করে দিয়েছে, তারপর আর কিছু বললে অন্য যে কোন রকম অঘটন ঘটিয়ে দিতে পারে। চানাচুরওয়ালার প্রতিই এখন বেশি রাগ হচ্ছে ফেরদৌসির। এই ব্যাটা অপদার্থই এতসব বিশ্রি ঘটনার জন্য দায়ি। ব্যাটাকে দু‘টা থাপ্পর লাগানো দরকার ছিল। কিছুটা তার হাজবেন্ডের প্রতিও হচ্ছিল। কেন যে সে এ ধরনের ট্রেন দিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া যেতে চাইলো।
এসব ট্রেনে হকার-মকার, ফকির-ফাকরা, আর পাগল-ছাগলে ভরপুর থাকবে এটাই তো স্বাভাবিক। ইন্টারসিটি ট্রেনে আসলে কি আর এ রকম পরিস্থিতির শিকার হতে হতো। যত্তসব আজব কান্ড। আবার পরক্ষণেই তার মনে হলো তিনি তো একটু আধটু লেখালেখিও করেন। শুধু ইন্টারসিটি ট্রেনে যাতায়াত করলে এদের দেখা পাবে কোথায়? এদের জীবন-জীবিকা সম্পর্কে ধারণা হবে কোত্থেকে? এদের জীবন সংগ্রাম, যাপিত জীবনের বিভিন্ন অলিগলি, সুখ-দুখও তো লেখনিরই অংশ। লেখককে যে সবকিছুকে পর্যবেক্ষণের দৃষ্টিতে দেখতে হয়। তাকে মিশতে হয় উঁচু-নিচু, ধনী-গরীব, বর্ণ-সম্প্রদায় সকল স্তরে নির্মোহ মনোভাব নিয়ে। পাগলি সংক্রান্ত ঘটনাগুলি ফেরদৌসির কাছে তার লেখনিরই উপদান বলে মনে হতে লাগল। এবং এ জন্য তার মধ্যে এক প্রকার প্রাপ্তির ভাব চলে আসল।
ফেরদৌসি এ সব কিছু ভাবছিল। আর এদিকে কিছুক্ষণ চুপ করে বসেছিল পাগলি। কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে আবার বলতে শুরু করল, কিগো সই। তুমি যে একবারে চুপ মাইরা গেলা। কি যেন ভাবতে লাগলা। আমারে নিয়া কিছু ভাবতাছ। কইলাম না আমার জামাই গোলামের পুতের
নাম ছিল রাহাত। রাহাইত্তা গোলামের পুতে আমার মন প্রাণ কাইরা নিয়া হের প্রেমের জালে আটকাইয়া আমারে ঘরের বাইর করল। কাঁচা বয়স ছিল সই। কিছুই বুঝবার পারি নাই। এরপর প্রতারণা ছাড়া গোলামের পুতের কাছে আর কিছুই পাইলাম না। এ কথা তো তোমারে কইলামই। কিলা সই তুই আমারে এখনও চিনতে পারছ নাই। ফেরদৌসি লক্ষ্য করল যে পাগলি এতক্ষণ তাকে তুমি তুমি করে বলছিল। আর এখন তুইতে চলে এসেছে। আরে রাহাইত্তা গোলামের পুতেরে আমি ভালবাসতাম বইল্লা আর হে বা হাইত্তা আছলি বইল্লা তরা
আমারে কত খ্যাপাইতি।
রাহাইত্তা বাহাইত্তা
উঁচা লম্বায় ছ‘হাইত্তা
——————
—————–।
কাঁচা বয়সের প্রেম। বুঝবার পারি নাই। আমার সামনে ছিল এস. এস. সি পরীক্ষা। হে পরীক্ষা ফালাইয়া আমি রাহাইত্তার হাত ধইরা এক কাপড়ে পালাইলাম। মা বাপরে কথা একবারও ভাবলাম না। এর শাস্তি আমি পাইছি সই। কমত পাইলাম না। মা বাপরে কথা ভাবলে, তাদের মান সম্মানের কথা ভাবলে ত আমার জীবন তরার মতোই অইত। বলেই চুপ হয়ে গেল পাগলি।
চুপ করে ট্রেনের জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে রইল সে। মনে হলো সেও কিছুক্ষণের জন্য ফিরে গেছে হারানো স্মৃতির দেশে।
ভাবতে লাগলেন ফেরদৌসি। ভাবনার পাখনায় ভর করে তিনিও চলে গেলেন সেই বিশ বছর আগে পিছনে ফেলে আসা তার শৈশবের সেই গ্রাম সুখনগর।
বিস্মৃত সেই ফেলে আসা সময়ে তার হারিয়ে যেতে সময় লাগেনি। পারুল আক্তার পরী। সবাই তাকে পরী নামেই ডাকত।
পরী আয়ত নয়না ছিপছিপে দেহ ও উজ্জল বর্ণের অধিকারী ছিল। নিরহঙ্কারী চঞ্চল, বাকপটুও বটে। যত্রতত্র ঘুরে বেড়াত। ঠিক চপলা চঞ্চলা কিশোরী যেমনটি হয়। কারণে অকারণে কথার খই ফুটত পরীর মুখে। মধ্যবিত্ত জীবনের চিত্রময়ী রূপিনী ছিল সে। কত উচ্ছাস, কত উদ্দিপনা, কত আনন্দের ঢেউ নিয়ে ছিল তার জীবন চলা। নিজের কাছে নিজের আত্নবিশ্বাসের টইটুম্বুর ছিল তার মন ও হৃদয়। ওর সহজ জীবন চিন্তা ওকে এগিয়ে নিয়ে যায় বাস্তবতার দ্বারা প্রান্তে। পড়ালেখা শিখে উচ্চ পদের অধিকারী হবে। মনের রঙ্গিন ডানায় ভর করে স্বপ্ন দেখে। আর স্বপ্নের স্বপনকে খুঁজে বেড়ায়।
সময়ের আবহে কখনো ভাবে স্বর্ণমিশ্রিত রক্তরাঙ্গা টিপ কপালে পড়ে কৈশোর অতিক্রম করে যৌবনে পদার্পন করবে। অভিভূত রূপে রূপান্বিত হবে। যা প্রতিটি অধরার কাক্সিক্ষত গোপন বাসনা হয়ে থাকে। যা অন্তর জগতের প্রতীক রূপে রূপায়িত বীজের বহিঃরেখার নান্দনিক প্রকাশ। কত উচ্ছাস, কত উদ্দিপনার ঢেউ নিয়ে প্রত্যাহিক জীবনের দৈনন্দিন ঘটনার মহা কালিকা রূপে আবর্তিত হয়েছিল ক্ষণ লগ্নগুলি। অসাধারণ কাল্পনিক দৃশ্যগুলো মনের নীল আকাশকে রাঙিয়ে দিত। আর চারপাশের সবুজের আচ্ছাদন মনকে করে তুলত যেন অনন্ত যৌবনা। যেন ব্যক্তিত্বের অর্ন্তগত ব্যুহসহজাত প্রক্রিয়া যা নিয়ন্ত্রিত করত পরী। তা বনের ফুলদের কাছে গিয়ে পরী বলে অশুভ গন্ধ মোকাবেলা কর আর নিজেকে বাঁচিয়ে রাখো, অক্ষুন্ন রাখ। আটুট রাখ হৃদয় ও চিত্ত। নির্মোহ ভাল লাগার সৌন্দর্যে ডুবে থাকো।
টগবগে জোয়ানের যৌবনের স্রোতে নিজেকে ভাসিয়ে দিয়ো না। সেই পরী কখন কিভাবে যেন মজেছিল রাহাত নামের তার চেয়ে দ্বিগুণ বয়সের লাফাঙ্গা লোকটির প্রেমে। মজল কি মজল। যেন কৃষ্ণের বাঁশি ঘর ছাড়া করল পরীকে। সারা গ্রামময় টি টি পড়ে গেল। পরী রাহাতের সাথে পালিয়ে গেছে। তার বাবা মাকে সে লজ্জা আর ঘৃণার অকুল সাগরে ভাসিয়ে দিয়ে গেল। এটা ভদ্রলোকদের গ্রাম। এ গ্রামে যাদের মেয়ে ছেলেদের সামলিয়ে রাখতে পারবে না তাদের এ গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে হবে। মাত্তাব্বদের দেয়া বিচারের রায়ে পরীর বাবা মা গ্রাম ছাড়া হলো। হায়রে পরী তুই যে পালিয়ে গিয়ে এমন অন্ধকার গহবরে পতিত হবি এ পাঠ কি তোর জানা ছিলনা। পোড়া কপালি পরী। তোর আজ এ কেমন রূপ! এমনটিইকি ছিল তোর কপালের লিখন।
এখন স্পষ্ট পরীকে চিনতে পারছে ফেরদৌসি। তাদের বাড়ি থেকে খুব বেশি দূরে ছিল না পরীদের বাড়ি। তাদের বাড়ির সামনে দিয়ে চলে গেয়েছিল গোপাট সাদৃশ বড় সরকারি রাস্তাটি। ওদের বাড়ি বরাবর রাস্তায় সাজানো গাছগুলো জোড়া কদম ও রেন কড়ই যেন ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড়। বাড়ির চারপাশ ছোট ছোট মন্দার গাছ দিয়ে ঘেরা। এ সুখনগর থেকে এক কিলোমিটার দূরে সাতইশ উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে একই ক্লাশে পড়ালেখা করত ফেরদৌসি ও পরী। সামনে নবম শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষা। পরীক্ষার আগে একই সাথে তারা গণিত প্রাইভেট পড়ত। বড় রাগি ছিলেন দস্তগীর স্যার।
প্রাইভেট পড়তে এসে পরীর চঞ্চলতাকে কোন ভাবেই বরদাস্ত করতেন না তিনি। কি একটি বিষয় নিয়ে যেন একদিন পরীর উপর রাগ করেছিলেন তিনি। আশেপাশে কিছু না পেয়ে স্টিলের স্কেল দিয়ে শাস্তি দিতে যাচ্ছিলেন দস্তগীর স্যার। চঞ্চলা পরী সহসা সরে যেতে চাইল। আর অমনি স্টিলের ধারালো কোণায় কেটে গেল পরীর কপালের বেশ খানিকটা অংশ। ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হতে লাগল। দস্তগীর স্যার হতবম্ব হয়ে গেলেন। কয়েকদিন পর যখন পরী কপালের বেন্ডেজ খুলল, তখন দেখা গেল তার কপালে একটি কাটা দাগ পরে আছে। সেই দাগটি দূর থেকে দেখা যেত। সে দাগটি এখনও রয়ে গেছে। দাগটির জন্য যে দস্তগীর স্যার কতবার দুঃখ প্রকাশ করেছে। আহা বেচারা দস্তগীর স্যার।
আর কেউ না জানুক অন্তত ফেরদৌসি তো জানতো যে দস্তগীর স্যার বাইরে থেকে পরীর উপর রাগ দেখালেও ভেতরে ভেতরে তিনি পরীকে ভীষণ ভালোবাসত। দস্তগীর স্যার আপনি যদি এখন দেখতেন আপনার পরী এখন কেমন আছে! এসব কথা যখন একের পর এক ফেরদৌসির মনের আয়নায় ভেসে উঠছিল তখন একবার প্রায় পরীকে (পাগলিকে) জড়িয়ে ধরতে গিয়েছিলেন তিনি। আবার পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার জন্য থামলেন। থেমে পরীকে বললেন, পরী আমি তুকে চিনতে পারছি। তুই আমার শৈশবের বান্ধবি। একই গ্রামে ছিল আমাদের বাড়ি। সাতাইশ স্কুলে একই ক্লাশে ত্ইু আর আমি পড়ালেখা করতাম। আমরা ছিলাম গলায় গলায় ভাব। তুর সব অবস্থা আমি পরে শুনবো। তুই আমাকে কথা দে। আর কোন প্রকার গালাগাল এ ট্রেনে কাউকে দিবি না।
-কথা দিলাম।
-ঠিক বলছিস তো?
-একশ পারসেন ঠিক কইলামত।
-তুকে আমি বাসায় নিয়ে যাব। তুই লক্ষী মেয়ের মতো আমার বাসায় যাবি। কোন প্রকার হই চই, গালাগালি চলবেনা। ঠিক থাকবে তো?
মাথা নোয়াল পরী।
বাসায় পৌছে পরীর সাথে অনেক কথা হলো ফেরদৌসির। দু‘ই বান্ধবি এক সাথে ভাত খেল। পরী স্বাভাবিক মানুষের মত ফেরদৌসির কাছে তার সব কথা বলল।
তার ঘটে যাওয়া দুর্ভাগ্যের সকল কাহিনী শুনল ফেরদৌসি। শুনে তার চোখের কোণেও দেখা দিল দু‘ফোটা অশ্রুবিন্দু। পরীকে জড়িয়ে ধরে বলল, পরী তুই তো এখনো সম্পূর্ণ স্বাভাবিক আছিস। তোর এখনকার কথাবার্তা শুনেতো মনে হচ্ছে না তুই কোন অস্বাভাবিক মানুষ। তবে তুই কেন খালি খালি পাগল সেজে আছিস? পরী, তুই আমার কাছে থেকে যা। তোর দোলাভাই খুব ভালো মানুষ। উনি কিছু মনে করবেন না।
-তা হয় নারে সই। তুই কেমন আছস, তরার জীবন কেমন। কেবল এই সব দেখার জন্যই আমি তোর সাথে তোর বাসা পর্যন্ত এসেছি। আমার দেখা হয়ে গেছে। দোয়া করি তুই ভালো থাকিস। আমি থাকার জন্য আয় নাই। আর তুই যে বললি আমি স্বাভাবিক মানুষ তা সত্যিই বলেছিস। কিন্তু আমি যে জগতের মানুষ হয়ে গেছি সে জগতে যদি স্বাভাবিক আচরণ করি তাহলে তো নারী লোভী জন্তুগুলির হাত হতে নিজের এ দেহটাকে একেবারেই বাঁচাতে পারব না। আমাদের জগতটা বড়ই কঠিন সই।
সেখানে পাগলি সেজেই তো নিজেকে বাঁচাতে পারি না। আর স্বাভাবিক আচরণ করলে তো কথাই নেই। বলে সিঁড়ি বেয়ে আস্তে আস্তে নিচে নেমে গেল পাগলি নামের পারুল আক্তার পরী। দু‘তলার রেলিং ধরে পরীর গমন পানে ফ্যাল ফ্যাল চোখে তাকিয়ে রইল ফেরদৌসি। এখন কোন পাগলামি নেই পরীর। কেমন দার্শনিক ভঙ্গিতে কথাগুলি বলে হাঁটতে থাকলো পরী। হাঁটতে হাঁটতে বড় রাস্তায় উঠে গেল সে। অন্ধকারের জন্য তাকে আর দেখা যাচ্ছিল না। সমান্তরাল রেখার মতো অন্ধকারের হাত ধরে ফেরদৌসির দৃষ্টির বাইরে চলে গেল পরী।
লেখক সম্পর্কে

-
লেখক পরিচিতি-
আমির হোসেন ১৯৭৩ সালে ৫ জানুয়ারি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগর উপজেলার গৌরনগর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মো. সুরুজ মিয়া ও মাতার নাম গুলবরের নেছা। তিনি ১৯৯৬ সালে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতে অনার্সসহ এম এস সি ডিগ্রী অর্জন করেন। পরবর্তীতে তিনি ২০০৩ সালে বি এড ও ২০১৫ সালে এল এল বি ডিগ্রী অর্জন করেন।
প্রকাশিত গ্রন্থ- নিমন্ত্রিত তমসা (কবিতা), ঝরাফুলের সুরভি (উপন্যাস), দার্শনিক কবি মাশরেকীর জীবন ও সাধনা (গবেষণা), ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার ইতিহাস (গবেষণা), জলময়ূরীর পেখম (গল্প), জলের গহীনে নীল জোছনা (কবিতা), মালালার আর্তনাদ (উপন্যাস), তোমার হরিণমায়া চোখ (গল্প), চালাক কুমির ও বোকা শেয়াল (শিশুতোষ গল্প), সিঁদুরের দেয়াল (উপন্যাস), রমেশ ঋষির সংসার (গল্প), ক্লান্তিহীন এক অভিযাত্রী মোকতাদির চৌধুরী (গবেষণা), ছোটদের বঙ্গবন্ধু (গবেষণা), সুখ নগরের সারথি (কবিতা), বাঁশির সুরে পরীর নাচ (শিশুতোষ) ও তিতাস পাড়ের গল্প (গবেষণা), মুক্তিযুদ্ধের গল্প (গল্প), মায়াবী মদিরাক্ষী ( কবিতা), বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবার (গবেষণা), বৃহন্নলা (উপন্যাস) ও হিরালী ও অন্যান্য গল্প (গল্প) ।
সম্পদনা- স্বদেশ, মিডিয়া ওয়ার্ল্ড, চিনাইরবার্তা ডটকম ও শোকাঞ্জলি।
তিনি ২০০৮ সালে দৈনিক যুগান্তর পত্রিকার (স্বজন সমাবেশ) বর্ষ সেরা লেখক সম্মাননা, ২০১৩ সালে তিতাস আবৃত্তি সংঠন সম্মননা পদক, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ২০১৪ সালে জননী সাহিত্য পদক, রাজশাহী, ২০১৪ সালে ইদ্রিস খান স্মৃতি সম্মননা পদক, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ২০১৪ সালে কবি এম. আমজাদ আলী স্মৃতি পদক, রাজশাহী, ২০১৫ সালে ‘মেঠোপথ’ সাহিত্য পদক কিশোরগঞ্জ, ২০১৮ সালে বেস্ট লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানী পুরস্কার ও ২০১৯ সালে সুমিতা সাহিত্যপত্র সম্মাননা, আগরতলা, ত্রিপুরা, ভারত লাভ করেন। তিনি শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন।
সর্বশেষ লেখা
গল্প২০২২.০২.০৯পাগলি – আমির হোসেন
গল্প২০২০.০৯.১১শাকিলার দু’চোখ ঝাপসা হয়ে আসে – আমির হোসেন
গল্প২০২০.০৯.১১উত্তরাধিকার – আমির হোসেন
গল্প২০২০.০৮.২৫অনন্ত অভিমুখে – আমির হোসেন